তোপধ্বনি শুনে সেহরি ও ইফতার করে মরক্কোবাসী
ইরাকিদের মতো মরক্কোর অধিবাসীরাও কামানের আওয়াজ অর্থাৎ তোপধ্বনি শুনে সেহরি ও ইফতার করে। প্রথমবার তোপধ্বনি দিয়ে জানান দেওয়া হয় সেহরির সময়। আর দ্বিতীয় তোপধ্বনির মানে হলো, সেহরির সময় শেষ- এখন আর খাওয়া যাবে না। এরপর ইফতারের সময়টিও জানিয়ে দেওয়া হয় কামানের গোলার আওয়াজে।
অন্য মুসলিম দেশগুলোর মতো মরক্কোতেও রমজান মাসে প্রতি রাতে তারাবি ও মধ্যরাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়েন ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা। আর দেশটির রমজানের আরেক অনুষঙ্গ হলো ঐতিহ্যবাহী টুপি– ফেজ। প্রতি রমজানেই ফেজ কেনেন পুরুষরা। এ মাসে তাঁরাও পবিত্র কোরআন খতম দেন।
দেশটিতে রমজানে নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করা হয়। মরক্কোয় অঞ্চল ভেদে খাবারে রয়েছে ভিন্নতা। পবিত্র এই মাস শুরুর কয়েকদিন আগে থেকেই শিশুদের মধ্যে আনন্দ দেখা যায়। কারণ রমজান মানে স্কুল নেই, থাকে না কোনো পরীক্ষাও।
মায়েরা নানা মজার খাবার তৈরি করেন এই মাসে। বাড়ির ভাঁড়ার ঘরগুলো থাকে নানা মজার খাবারের উপকরণে ঠাসা। মরক্কোয় ইফতার করা হয় বেশ জাঁকজমকের সাথে। ইফতারকে বলা হয় ‘এফতোর’। এই ‘এফতোর’ এর খাবারের আয়োজন নিয়ে রমজান মাসে দেশটির রাস্তাগুলো খাবারের বাজারে পরিণত হয়।
অন্যান্য আরব দেশগুলোর মতো মরক্কোবাসীর মধ্যেও পারিবারিক বন্ধন চোখে পড়ার মতো। সবাই একসঙ্গে বসে ইফতার করে। ইফতারে থাকে দেশটির ঐতিহ্যবাহী নানা খাবার; যেমন- ক্রাচেল, হারিরা, ব্রিওয়াত, ছোট আকারের স্টিল্লা, স্যাল্লো, রিজ্জা, মিস্সামেন, মালবি, বাঘরির, হারশা এবং কুসকুস। একসাথে তিন থেকে চারটি টেবিলে এই খাবার পরিবেশন করা হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে মরোক্কানরা ইফতার করেন। এ সময় তারা কোরআন তিলাওয়াত শুনেন অথবা গল্প করেন। এবং মহিলারা নানা ধরনের খাবারের রেসিপি আদান-প্রদান করেন।
রেসিপি : হারিরা
স্যুপ জাতীয় ‘হারিরা’ মজাদার ও পুষ্টিকর খাবার । সারাদিন রোজা রাখার পর এই খাবার রোজদারদের জন্য খুবই উপযোগী। এটি ইফতারেই বেশি জনপ্রিয়। মরক্কোর নাগরিকরা খেঁজুর আর শরবত দিয়ে রোজা ভাঙার পর ঐতিহ্যবাহী ডালের স্যুপ ‘হারিরা’ খায়। তার সঙ্গে থাকে মধু দিয়ে তৈরি পাউরুটি ‘ক্রাচেল’ বা সুজি দিয়ে তৈরি নোনতা ঝুরি রুটি ‘হারশা’। এটি ব্রাই আর রাস্পব্যেরি জ্যাম দিয়ে খেতেও খুব মজা লাগে।
পরিমাণ : ছয় থেকে আটজনের জন্য
তৈরির উপকরণ
আধা কেজি টুকরো টুকরো করে কাটা ভেড়া অথবা গরু অথবা মুরগির মাংস, ভোজ্য তেল অথবা মাখন তিন টেবিল চামচ, ধনেপাতা কুচি ১/৪ কাপ, দেশটির স্থানীয় সুগন্ধি পাতা ‘পার্সলে’ কুচি ১/৪ কাপ, এক বা দুটি পাতাসহ সেলারি গুল্মের পাতা কুচি, বড় পেঁয়াজ কুচি, সারা রাত ভিজিয়ে খোসা ছাড়ানো এক মুঠো শুকনো ছোলার ডাল, এক মুঠো মসুর ডাল, এক টেবিল চামচ দারুচিনি, এক টেবিল চামচ আদা বাটা, আধা টেবিল চামচ গোল মরিচের গুঁড়ো, এক টেবিলচামচ লবণ, আধা টেবিল চামচ হলুদ গুঁড়া, ছয়টি খোসা ছাড়ানো টমেটো ভর্তা, এক থেকে দুই কাপ পানি মেশানো তিন টেবিল চামচ টমেটো পেস্ট, দুই থেকে তিন টেবিল চামচ চাল এবং এক কাপ ময়দা।
প্রস্তুত প্রণালি
প্রেসার কুকারে তেল দিয়ে টুকরো করে কাটা মাংস কয়েক মিনিট সেদ্ধ করে নিতে হবে। এরপর এতে হলুদ, গোলমরিচের গুঁড়া, দারুচিনি, আদা, লবণ, টমেটো ভর্তা, ধনেপাতা কুচি, সেলারি গুল্ম কুচি, পেঁয়াজ কুচি, খোসা ছাড়ানো ডাল এবং তিন কাপ পানি সব একসাথে দিতে হবে। এরপর ঢাকনা দিয়ে মাঝারি আঁচে ২০ থেকে ৩০ মিনিট রাখতে হবে।
চুলা থেকে নামিয়ে এবার এর সঙ্গে চাল, মসুর ডাল, টমেটো পেস্ট, দুই লিটার পানি দিতে হবে। এরপর আবার চুলায় দিয়ে মাঝারি আঁচে ৩০ মিনিট রান্না করতে হবে। এই স্যুপ ঘন করার জন্য দুই কাপ পানিতে ময়দা ভালো করে মিশিয়ে রান্না করা উপাদানের ওপর ঢেলে নাড়তে হবে কয়েক মিনিট। এরপর নামিয়ে গরম গরম পরিবেশন করতে হবে দারুণ স্বাদের ‘হারিরা’ স্যুপ।
রেসিপি: কুসকুস
সেমোলিনা গমের গুঁড়ো বা কাউন দিয়ে বানানো ‘কুসকুস’ রমজানের সময় মরক্কোতে একটি জনপ্রিয় খাবার। এই মজাদার খাবারটি দ্রুত তৈরি করা যায়।
পরিমাণ : ছয় থেকে আটজনের জন্য
তৈরির উপকরণ : ১/৪ টেবিল চামচ জিরার গুঁড়া, আধা টেবিল চামচ আদা বাটা, ১/৪ টেবিলচামচ লবঙ্গ গুঁড়া, ১/৮ লাল মরিচের গুঁড়া, আধা টেবিল চামচ এলাচ গুঁড়া, ১/৪ টেবিল চামচ ধনে গুঁড়া, ১/৪ টেবিল চামচ অলস্পাইস, এক টেবিল চামচ অলিভ তেল, একটি পেঁয়াজ চাক চাক করে কাটা, কমলার খোসা গুঁড়া, সবুজ ও হলুদ রঙের ক্যাপসিকাম টুকরো করে কাটা, দুটি জুচিনিস (কুমড়াজাতীয় খাবার) টুকরো টুকরো করে কাটা, একটি টমেটো টুকরো টুকরো করে কাটা, অর্ধেক কাপ কিশমিশ, এক টেবিল চামচ লবণ, আধা কাপ সেদ্ধ মুরগির মাংস, আধা কাপ কমলার জুস, আধা কাপ কুসকুস (কাউন), তিন টেবিল চামচ পুদিনা পাতা কুচি।
প্রস্তুত প্রণালি : কড়াইয়ে অল্প আঁচে তাতে সব মসলা দিতে হবে। সুঘ্রান বের না হওয়া পর্যন্ত দুই থেকে তিন মিনিট ভাজতে হবে। এরপর এতে ক্যাপসিকাম টুকরো, টমেটো টুকরো ও জুচিনি টুকরো দিয়ে পাঁচ মিনিট রান্না করতে হবে। এরপর কিশমিশ, লবণ, কমলার খোসা গুঁড়া মেশানোর পর পানি দিয়ে সেদ্ধ করতে হবে। সেদ্ধ মাংস ও কমলার জুস মিশিয়ে উচ্চ তাপে ফুটাতে হবে। এভাবে পাঁচ মিনিট রাখার পর তার উপর পুদিনা পাতা দিয়ে পরিবেশন করতে হবে।