শবে কদর
হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ যে রজনী
এই রজনীর নাম শবে কদর। তবে আল কোরআন ও হাদিসের পরিভাষায় তা লাইলাতুল কদর বলেই উল্লেখিত হয়েছে। যদিও আল কোরআনের সূরা আদ-দুখানে লাইলাতুল মুবারাকাহ বলে এ রাতটিকেই বোঝানো হয়েছে।
‘কদর’ শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে তাকদির বা ভাগ্য। সুতরাং লাইলাতুল কদর অর্থ ভাগ্যরজনী। এ রাতে সব বিজ্ঞ ও হেকমতপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা করা হয়। তা ছাড়া এ রাতে আগামী এক বছরের রিজিক, বৃষ্টি ও হায়াত-মাউত, এমনকি ‘বাইতুল্লাহ’তে গিয়ে হজকারী ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
‘কদর’ শব্দের আরেকটি অর্থ হচ্ছে মর্যাদা বা সম্মান। সুতরাং লাইলাতুল কদর অর্থ মর্যাদা বা সম্মানের রাত। সত্যিই তো, এ রাতের ইবাদতকারীর জন্য রয়েছে বিশাল মর্যাদা এবং সম্মান।
এ রাতের মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।’ (সূরা আল-কদর, আয়াত নম্বর-৩)
হাজার মাসে হয় ৮৩ বছর চার মাস। আসলে গুণে গুণে ৮৩ বছর চার মাস নয়; বরং আরবের অধিবাসীদের স্বভাবই এই রকম ছিল যে বিপুল সংখ্যার ধারণা দেওয়ার জন্য তারা ‘আলফ’ তথা হাজার ব্যবহার করত। তাই আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে, এ একটি রাত এত বড় নেকি ও কল্যাণের কাজ হয়েছে, যা মানবতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে কোনো দীর্ঘতম কালেও হয়নি।
হজরত আলী ইবনে উরওয়াহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল (সা.) বনি ইসরাঈলের চারজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, তাঁরা ৮০ বছর পর্যন্ত একাগ্রচিত্তে নিয়মিত আল্লাহর ইবাদত করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তাঁরা এক চোখের পলক ও আল্লাহর নাফরমানি করেননি। তাঁরা হলেন হজরত আইয়ুব (আ.), হজরত জাকারিয়া, হজরত হিযকিল এবং হজরত ইউশা বিন নূন। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম আশ্চর্যান্বিত হলেন। তখন হজরত জিবরাঈল (আ.) বলেন, হে মুহাম্মদ (সা.), আপনার উম্মতরা তাদের ইবাদতের কথা শুনে আশ্চর্যান্বিত হয়েছে। তবে আল্লাহতায়ালা এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ জিনিস আপনার উম্মতের জন্য অবতীর্ণ করেছেন। অতঃপর জিবরাঈল (আ.) পাঠ করলেন—ইন্না আনজালনা হু ফি লাইলাতিল কদর… হাত্তা মাত্বলাঈল ফাজর পর্যন্ত।
এই রাতটি উম্মতে মুহাম্মদির জন্য সৌভাগ্যের পরশ পাথরের মতো, যারা এ রাতের সংস্পর্শে থাকবে এবং পাবে, তারা চরম ভাগ্যবান বান্দা হিসেবে মহান রবের সকাশে মর্যাদা লাভে ধন্য হবে।
এ রাতের ইবাদতের মর্যাদা বর্ণনায় আল্লাহর প্রিয়তম হাবিব (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কদরের রাত ইমান ও সওয়াবের নিয়তে ইবাদতে কাটাবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’
লাইলাতুল কদর রামাদানের কোন তারিখের রাতকে বলা হবে, তা নিয়ে রয়েছে মতবিরোধ। তবে প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, তোমরা রামাদানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করো। (বুখারি)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, নবী করিম (সা.) বলেন, লাইলাতুল কদরকে তোমরা রামাদানের শেষ দশকে মাসের নয় দিন বাকি থাকতে, সাত দিন বাকি থাকতে এবং পাঁচ দিন বাকি থাকতে তালাশ করো (বুখারি)।
এর মর্মার্থ হলো রমজানের ২১, ২৩, ২৫ তারিখের রাতে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করো।
হজরত আবু যারকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি বলেন, হজরত উমর (রা.) হজরত হূযাইফা (রা.) এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) বহু সাহাবার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে, এটি রামাদানের সাতাশতম রাত। (ইবনে আবী শাইবা)
হজরত উবাদাহ ইবনে সামেত (রা.) বর্ণনা করেন : রাসূল (সা.) বলেন, রামাদানের শেষ ১০ রাতের বিজোড় রাতগুলো, যেমন—একুশ, তেইশ, পঁচিশ, সাতাশ ও ঊনত্রিশ বা শেষ রাতের মধ্যে রয়েছে লাইলাতুল কদর। (মুসানাদে আহমদ)
আল্লাহর প্রিয়তম হাবিবও এ রাতের সর্বাধিক মর্যাদার কারণে রামাদানের শেষ ১০ দিন ইবাদতে অধিক প্রচেষ্টায় কাটাতেন।
হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) রামাদানের শেষ দশকে ইবাদতে এত প্রচেষ্টা-পরিশ্রম করতেন, যে প্রচেষ্টা-পরিশ্রম অন্যদিনে করতেন না। (মুসলিম)
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, যখন রামাদানের শেষ দশক আসত, তখন রাসূল (সা.) ইবাদতের জন্য লুঙ্গি শক্ত করে বেঁধে ফেলতেন, (সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন) আর সারা রাত জেগে জেগে ইবাদত করতেন এবং পরিবার-পরিজনকে জাগাতেন। (বুখারি ও মুসলিম)
এ রাতে আল্লাহর প্রিয় হাবিবের শেখানো দোয়াটি হলো—আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।
পরিশেষে, এ রাতের এত মর্যাদার কারণ হওয়ার নেপথ্যে কাহিনীটি লিখতে চাই। আর তা হলো—এ রাতে নাজিল করা হয়েছে সারা দুনিয়ার ভাগ্য পাল্টে দেওয়ার মতো সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থ ‘আল কোরআন’, যা মানবতার সব সমস্যার সমাধান নিয়ে অবতারিত। এর প্রতিটি বিধান মানবজীবনের কল্যাণে নিবেদিত। এটি শুধু মুসলমানদের জন্যই রহমত নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমত। সুতরাং, আল কোরআনের সংস্পর্শে না এলে সব অর্জনই ব্যর্থ হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন : প্রভাষক, আরবি বিভাগ, উত্তর বাড্ডা ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা।