হজের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি
বিশ্বপরিচালক আল্লাহ তায়ালার সকাশে মনোনীত একমাত্র জীবন বিধান ইসলামের পাঁচটি মৌলিক ভিত্তির মধ্যে হজ অন্যতম। এটি একটি অনন্য বৈশিষ্টমণ্ডিত ইবাদত। কেননা এর মধ্যে শারীরিক ও আর্থিক উভয় ইবাদতের সংমিশ্রণ হয়ে থাকে। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে ‘হজ’ শব্দটি বিভিন্ন রূপে মোট ১১ বার এসেছে। আর ‘হজ’-এর প্রকৃত অর্থ সংকল্প করা, নিয়ত করা ও ইচ্ছা করা। সত্যিই আল্লাহর ঘরের মেহমান হাজিসাহেব এক অনুপম ইচ্ছা পোষণ করেন, যার মধ্যে শুধু তাঁর সন্তুষ্টিই মুখ্য হয়ে থাকে। আর সেটি আল্লাহর বাণীর মাঝেও চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহ তায়ালার (সন্তুষ্টির) জন্য হজ ও ওমরা সম্পন্ন করো।’ (বাক্বারা-১৯৬)
এ কথা ধ্রুব জ্যোতির মতো স্পষ্ট যে, ইসলাম একজন মুসলিমের জীবনে একবারই হজ পালন করা ফরজ করেছে। আল্লাহর প্রিয়তম হাবিব হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর জবান মোবারক দিয়ে তাই ধ্বনিত হয়েছে। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘রাসুল (স.) একদা আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দানকালে বলেন, হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের ওপর হজ ফরজ করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা হজ পালন করো।’ অতঃপর এক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! প্রতিবছরই কি আমাদের এ হজ পালন করা ফরজ? তখন রাসুল (স.) চুপ রইলেন। (কোনো জবাব দিলেন না) লোকটি তাঁর এ প্রশ্ন তিনবার করল। অতঃপর রাসুল (স.) বললেন, তোমার প্রশ্নের জবাবে আমি যদি ‘হ্যাঁ’ বলতাম তাহলে তোমাদের ওপর প্রতিবছর হজ পালন করা অবশ্যই ফরজ হয়ে যেত। আর তোমরা (তখন) তা পালন করতে সক্ষম হতে না...।’
সুতরাং যে হজ জীবনে একবার মাত্র ফরজ, যা আদায় করলে পূর্বের গুনাহ মাফ হয়ে নিষ্পাপ শিশুর মতো হয়ে যায় এবং যার বিনিময়ে শুধুই জান্নাত, সেই হজ ব্রত পালনের জন্য চাই একটি সুন্দর প্রস্তুতি। কেননা, যে কোনো কাজের জন্য সুন্দর প্রস্তুতি সে কাজটিকে চমৎকার রূপে পালন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তবে এ ক্ষেত্রে হাজিসাহেবের মানসিক প্রস্তুতির বিষয়টি সর্বাগ্রে স্থান পাবে। হজের সফর জীবনে একবারই মনে করে এই সফরকে জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তনের কাজে লাগাতে হবে। এখানে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্যেই যাওয়া হচ্ছে, তা মনের গভীরে নিতে হবে। আর তাতে শারীরিক দুর্বলতা থাকলেও মহান রবের অসীম করুণায় তা দূর হয়ে যায়। এর বহু দৃষ্টান্ত আমাদের জানা আছে।
-একজন হাজিসাহেবের ধৈর্য থাকতে হবে, থাকতে হবে তার ত্যাগের মানসিকতা। নিয়তকে খাটি করে নেওয়া একজন হাজিসাহেবের এক নম্বর কাজ। তাই সুখ্যাতি, ব্যবসা, কেনাকাটা, অথবা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে হজ করার মনোভাব পরিহার করতে হবে।
* বাড়ি থেকে বের হওয়ার পূর্বেই বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনদের থেকে মিথ্যা বলা, খারাপ আচরণ ও তাদের মনে ব্যথা দেওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে এবং তাদের হক আদায় করে দিতে হবে।
* বের হওয়ার সময় ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্র-ব্রাশ (মেসওয়াক), পেস্ট, টয়লেট পেপার, আয়না, চিরুনি, তেল, সাবান, তোয়ালে, শ্যাম্পু, নোট বুক, ডিটারজেন্ট ও প্রয়োজনীয় এষুধপত্র ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। জুতার ব্যাগ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংরক্ষণের জন্য ছোট ব্যাগ সঙ্গে নিলে ভালো হবে। এ ক্ষেত্রে বেশি মালামাল নিয়ে বোঝা ভারী করা যাবে না, আবার কম নিয়ে অপ্রস্তুত হওয়া যাবে না। তবে হাজিসাহেবের সঙ্গে কিছু শুকনো খাবার থাকা চাই।
যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন সঙ্গে নেওয়া ভালো।
* প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সতর্কতার সঙ্গে নিতে হবে। সঙ্গে কিছু সৌদি রিয়াল ও বাংলা টাকা রাখা যেতে পারে। কোরবানি করার মতো সৌদি রিয়াল সঙ্গে থাকা অবশ্যই চাই।
* হাজিসাহেব কোন ধরনের হজ করবেন তা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশি মুসলমানরা অধিকাংশই হানাফি মাজহাবের অনুসারী হওয়ায় তারা সাধারণত ‘হজে কেরান’ করে থাকেন। তবে এ ক্ষেত্রে মুয়াল্লিমরা প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা টাইম টু টাইম দিয়ে থাকেন।
* বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় খোশমেজাজে পরিবার থেকে বিদায় নেবেন। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় নিম্নোক্ত দোয়াটি পাঠ করবেন, ‘বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।’
* সিঁড়ি বা লিফটে করে ওঠার সময় ‘আল্লাহু আকবার’ এবং নামার সময় ‘সুবহানাল্লাহ’ বলা উত্তম।
* স্থলভাগের কোনো যানবাহন বা বিমানে আরোহণ করার সময় নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়ে নেওয়া ভালো। ‘সুবহানাল্লাজি ছাখখারা লানা হাযা ওয়ামা কুন্না লাহু মুকরিনিন ওয়া ইন্না ইলা রাব্বিনা লামুনকালিবুন’।
* হজক্যাম্পে থাকা অবস্থায় হজ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করলে আরো অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারবেন।
* হাজিসাহেব যদি প্রথমে মক্কা মুয়াজ্জামায় যেতে চান, তাহলে বাসা বা হজক্যাম্প থেকে অথবা বিমানবন্দর থেকেই ইহরামের কাপড় পরবেন। তবে ইহরামের কাপড় বিমানেও পরা যেতে পারে। কিন্তু তা অবশ্যই মিকাতের আগেই হতে হবে। বাংলাদেশি হাজিদের মিকাত হলো ‘ইয়ালামলাম’।
* ইহরামের কাপড় বাসা থেকে পরে বের হয়ে, তারপর নিয়ত করা যেতে পারে। এতে কিছু বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
* ইহরাম বাঁধার আগে সাধারণত পরিচ্ছন্নতার কাজ সেরে নিতে হবে। যেমন- নখ কাটা, চুল কাটা, গোপন স্থানের লোম কাটা এবং প্রয়োজনে গোঁফ ছোট করা যেতে পারে। গোসল করে, গোসল সম্ভব না হলে অজু করে এহরাম বাঁধবেন।
ঋতুবতী নারী গোসল করে ইহরাম বাঁধবেন। উক্ত নারী হজ ও ওমরাহর সকল নিয়মকানুন পালন করবেন। তবে ঋতু শেষ না হওয়া পর্যন্ত ‘মসজিদে হারামে’ প্রবেশ করবেন না এবং সালাতও আদায় করবেন না।
* পুরুষের ইহরামের কাপড় পরার আগে চুলে তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার করতে পারবেন। তবে ইহরাম বাঁধার পরে পারবেন না। ইহরামের কাপড়ে কখনো সুগন্ধি লাগানো যাবে না। নারীরা কোনো অবস্থাতেই সুগন্ধি ব্যবহার করবেন না।
ইহরাম বাঁধার সময় অবশ্যই তালবিয়াহ পাঠ করতে হবে। তালবিয়াহটি হলো, ‘লাব্বাইক, আল্লাহুমা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নিয়মাতা লাকা ওয়াল মূলক, লা শারিকা লাক।’
* পুরুষরা তালবিয়াহটি একটু উঁচু স্বরে পাঠ করবেন। পক্ষান্তরে, নারীরা কোমল স্বরে অথবা নীরবে পাঠ করবেন।
* পুরুষরা ইহরামের পোশাক হিসেবে সেলাইবিহীন দুই খণ্ড কাপড় পরিধান করবেন। একটি লুঙ্গির মতো করে পরবেন, যাকে ‘ইযার’ বলে। অপর খণ্ড দিয়ে শরীরের ওপরের অংশ আবৃত করবেন, তাকে ‘রিদা’ বলে।
* নারীরা তাঁদের স্বাভাবিক পোশাকের মতো সেলাইযুক্ত কাপড় পরিধান করতে পারবেন। তবে ইসলামী শরিয়াহ অনুসারে মুখমণ্ডল খোলা রেখে অবশ্যই পর্দা করতে হবে।
* হাজিসাহেব যদি প্রথমে মদিনায় যেতে চান তাহলে ইহরাম কাপড় পরিধান করার দরকার নেই।
* উল্লেখ্য যে, একজন নারী হজযাত্রীর সঙ্গে অবশ্যই ‘মাহরাম’ বা তাঁর স্বামী থাকতে হবে। মাহরাম হলো ওই ব্যক্তি, যাঁর সঙ্গে কখনো উক্ত মহিলার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েজ নেই।
* বদলি হজ আদায়কারীর জন্য অবশ্যই তাঁর নিজের হজ সম্পন্নকারী হতে হবে। অন্যথায় অন্যের হজ আদায় করা জায়েজ হবে না।
লেখক : প্রভাষক, আরবি বিভাগ, উত্তর বাড্ডা ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা।