ষষ্ঠীপূজায় দুর্গোৎসবের শুভারম্ভ
ঢাকের শব্দ আর মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে আজ। ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসব। এর আগে রোববার সন্ধ্যায় ‘দুর্গতিনাশিনী’ দেবী দুর্গার বোধন অনুষ্ঠিত হয়।
আজ ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু পাঁচদিনের এ উৎসব। ষষ্ঠীর পর আগামী মঙ্গলবার সপ্তমীর সকালে চক্ষুদানের মধ্য দিয়ে ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করা হবে ত্রিনয়নী দেবীর প্রতিমায়। বুধবার মহাষ্টমী ও কুমারী পূজা। এদিন রাজধানীর ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে বরাবরের মতোই প্রথা মেনে কুমারী পূজার আয়োজন করা হবে।
বিশুদ্ধ পঞ্জিকা মতে, আগামী শুক্রবার সকাল ১০টা ২৭ মিনিটের মধ্যে বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এ উৎসবের। অবশ্য এবার নবমী ও বিজয়া দশমীর তিথি পড়েছে একই দিনে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে এবার নবমী ও দশমী একই দিনে পড়ায় অনেক জায়গায় বৃহস্পতিবার দেবীর বিসর্জন দেওয়া হবে। আবার একটি বছরের জন্য কৈলাসে দেবালয়ে ফিরে যাবেন দেবী দুর্গা।
হিন্দু পুরান অনুযায়ী, দুর্গাপূজার সঠিক সময় হলো বসন্তকাল। রাবণবধের জন্য দেবতাদের জাগিয়ে তুলতে এই দিনেই অকাল বোধন করেন রামচন্দ্র ও রাজা সুরথ। সেই থেকে অকালবোধন হওয়া সত্ত্বেও শরৎকালে দুর্গাপূজা প্রচলিত হয়ে যায়। সে কারণে ষষ্ঠীতেই শুরু হয় দুর্গাপূজা।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে স্বর্গলোক কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যে আসেন। চার সন্তান লক্ষ্মী, কার্তিক, সরস্বতী আর গণেশকে নিয়ে নির্দিষ্ট তিথি পর্যন্ত বাবার বাড়িতে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে।
দেবীর অবস্থানকালে এই পাঁচদিন পৃথিবীর ভক্তরা ‘দেবী মা’-এর বন্দনা করেন। কল্পারম্ভের মাধ্যমে সূচনা হয় পূজার। তারপর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্যে মাকে বরণ করে নেওয়া হয়। রীতি অনুযায়ী, বোধনেই মায়ের মুখ উন্মোচন হয়।
এবার দেবী দুর্গা মর্ত্যে আসবেন ঘোড়ায় চড়ে আর পিতৃগৃহ থেকে তিনি কৈলাসে ফিরে যাবেন দোলায় চড়ে। মণ্ডপের ভেতর প্রতিমা আসার পর থেকেই ঢাকের শব্দে শুরু হয়েছে উৎসবের।
ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের সহসম্পাদক এবং পূজার তন্দ্রধারক স্বামী স্থিরাত্মানন্দ মহারাজ (নিরঞ্জন মহারাজ) বলেন, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার ঘোড়ায় চড়ে কৈলাস থেকে মর্ত্যলোকে আসবেন। এতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রোগ-শোক, হানাহানি, মারামারি বাড়বে। অন্যদিকে কৈলাসে (স্বর্গে) বিদায় নেবেন দোলায় চড়ে। যার ফলে বিশ্বে মড়ক, ব্যাধি ও প্রাণহানির মতো ঘটনা বাড়বে।
পূজাকে আনন্দমুখর করে তুলতে দেশজুড়ে বর্ণাঢ্য প্রস্তুতি এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। সারা দেশে এখন বইছে উৎসবের আমেজ। ঢাকঢোল কাঁসা এবং শঙ্খের আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠেছে বিভিন্ন মণ্ডপ। সকাল থেকে চণ্ডীপাঠে মুখরিত ছিল সব মণ্ডপ এলাকা।
পুজার সাজে সেজেছে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির, রমনা কালীমন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, ভোলানাথ মন্দির আশ্রম, জগন্নাথ হল, ঋষিপাড়া গৌতম মন্দির, গুলশান-বনানী সার্বজনীন পূজা পরিষদ মণ্ডপ, বাসাবো বালুর মাঠ, বনানী পূজামণ্ডপ, কলাবাগান পূজামণ্ডপ, শাঁখারীবাজার, মিরপুর কেন্দ্রীয় পূজামণ্ডপ, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দির পূজামণ্ডপ প্রভৃতি। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, সিলেট, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশেই আনন্দে মেতেছে সবাই।
পূজা উপলক্ষে সারা দেশে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের প্রতিটি পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা রক্ষায় পুলিশ, আনসার, বিজিবি, র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। ঢাকা মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারা দেশে ২৯ হাজার ৭৪টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হচ্ছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় মণ্ডপের সংখ্যা ২২২টি। এবার পূজার সরকারি ছুটি ২২ অক্টোবর।
দেশের প্রতিটি পূজামণ্ডপে পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির উদ্যোগে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, শুধু ঢাকার মণ্ডপগুলোতে এবার ছয় হাজারেরও বেশি পুলিশ সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন।
দুর্গোৎসব চলাকালে পূজামণ্ডপগুলোতে প্রতিদিনই অঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ, ভোগ ও আরতি অনুষ্ঠান হবে। এ ছাড়া আলোকসজ্জা, আরতি প্রতিযোগিতা, স্বেচ্ছায় রক্তদান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে দেশের হিন্দুধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। দুর্গোৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা হিন্দু সম্প্রদায়সহ ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশের সব নাগরিককে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।