দেবী দুর্গার মুখ দেখেন না ‘মহিষাসুরের বংশধররা’
শারদ উৎসবে বিশ্বব্যাপী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পূজিত হন দেবী দুর্গা। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হিন্দু ধর্মাবলম্বীর দেশ ভারতেই এমন কিছু মানুষ আছে, দেবী দুর্গার মুখ দেখা যাদের কাছে পাপ! তাই দুর্গা পূজার কয়েক দিন প্রাণপণে তাঁরা চেষ্টা করেন যাতে দেবীর মূর্তি দেখতে না হয়। কারণ তাঁরা নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলে মনে করেন।
ঝাড়খন্ড এবং উত্তরাখন্ডের সীমান্তের আলিপুরদুয়ারা জেলার মাঝেরডাবরি এলাকার একটি গ্রাম অসুরা কিংবা ‘অসুর গ্রাম’। ‘তফশিলী উপজাতি’র অন্তর্গত আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রায় আট হাজার মানুষের বাস এখানে। পরম্পরা অনুযায়ী নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর দাবি করেন তাঁরা। এই সম্প্রদায়ের পদবীও ‘অসুর’। বহুকাল ধরে বংশপরম্পরায় আদিবাসী এই জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, তাঁরা মহিষাসুরের বংশধর।
এই বিশ্বাস ব্যাখ্যায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ মার্কন্ডেয় পুরাণের আখ্যান অনুসরণ করেন তাঁরা। এই জনগোষ্ঠী মনে করেন, দেবী দুর্গার হাতে মহিষাসুর বধ আসলে দেবতাদের ষড়যন্ত্র। তাই অসুরদের বংশধররা দুর্গাপূজার চারদিন মহিষাসুরের জন্য আলাদা পূজার আয়োজন করে। মূর্তিপূজায় অবিশ্বাসী এই সম্প্রদায় দুর্গাপূজার কয়েকদিন শোক দিবস পালন করেন।
হিন্দু পুরাণের বর্ণনা অনুসারে মহিষাসুর নিজেও একজন রাজার ছেলে। অসুররাজ রম্ভার ছেলে। মহাদেব শিবের বরে রম্ভা এবং মহিষরূপী শাপগ্রস্ত রাজকুমারী শ্যামলার মিলনেই জন্ম হয়েছিল মহিষাসুরের। তাঁর জন্মের পর দেবতা-অসুরের যুদ্ধে দেবরাজ ইন্দ্রের হাতে নিহত হন রম্ভা।
এর প্রতিশোধ নিতে ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা শুরু করেন মহিষাসুর। কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বর দেন ব্রহ্মা। বরটি ছিল, ত্রিভুবনের কোনো পুরুষই তাঁকে পরাস্ত করতে পারবে না। এই বর পেয়ে আরো পরাক্রমশালী ও অত্যাচারী হয়ে ওঠেন মহিষাসুর। স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেন দেবতাদের। বিতাড়িত দেবতারা শিব ও বিষ্ণুর কাছে তাঁদের দুঃখের বিবরণ দেন। এরপরের ইতিহাস অবশ্য বহুল চর্চিত। দেবালোকেই দেবতাদের সম্মিলিত তেজ থেকে দেবী দুর্গার আবির্ভাব। এরপরের টানা নয়দিনের যুদ্ধে মাতৃরূপী দুর্গার হাতে পরাভব ঘটে অসুররূপী মহিষাসুরের।
অবশ্য এসব পুরাণ কথার বাইরে গিয়ে তফশিলী উপজাতিদের ভাষা ও নৃতাত্তিক বিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করেছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হরিপ্রসাদ মান্ডা। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে তিনি জানান, এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আদি বসবাস ছিল ছোটনাগপুরের এলাকার মালভূমিতে। ব্রিটিশরা এঁদের চা বাগানের কাজে লাগিয়েছিল। সেই থেকে এঁরা থেকে গেছেন উত্তরবঙ্গের চা বাগান এলাকায়।
অধ্যাপক হরিপ্রসাদ জানালেন, এই জনগোষ্ঠীর পদবিতে অসুর শব্দ এসেছে বংশপরম্পরায় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে। এর নেপথ্যে কোনো লিখিত প্রমাণ নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি। জনশ্রুতিতে আস্থা রেখেই বংশপরম্পরায় চলে আসছে ধ্যানধারণা।
হরিপ্রসাদ আরো জানান, হিন্দুদের চতুর্বেদের অন্যতম ঋগ্বেদ এবং সামবেদের যুগে ‘অসুর’ বলতে বোঝানো হত শক্তিশালী পুরুষকে। পরে কালক্রমে সেই শব্দটির অর্থ পরিবর্তিত হয়ে ‘দানব’ বা ‘বিনাশী’ অর্থ প্রকাশ করে।
তবে দুর্গাপূজার সময় দেবীর মুখ না দেখার এই ঐতিহ্য কতদিন টিকে থাকবে সে নিয়েও সংশয়ে ‘অসুর’ সম্প্রদায়ের প্রবীণরা। কারণ সম্প্রদায়ের নবীন প্রজন্ম মানতে চায় না পুরোনো গল্প। এমনকি অনেকে গা ভাসান চিরাচরিত শারদোৎসবে। আশঙ্কা আর পরম্পরা নিয়ে এভাবেই উজান স্রোতে সাঁতার দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন ‘মহিষাসুরের বংশধররা’।