উল্লাস আর বিষাদে দেবী দুর্গার বিসর্জন
শাস্ত্র আর তিথির হিসাব মেনে গত বছরের মতো এবারও তিন দিনে শেষ হয়ে গেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। তিথি অনুযায়ী নবমী ও দশমী একই দিনে হওয়ায় শারদীয় দুর্গাপূজা শেষ হয়েছে গতকাল। আর তাই প্রতিমাকে ঘিরে উল্লাসের পাশাপাশি বিষাদের সুর বেজে উঠেছে কোথাও কোথাও।
অধিকাংশ স্থানেই আজ প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। বিভিন্ন আচারের মধ্য দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায় উদযাপন করছে তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার মহানবমী ও দশমী। চন্দ্রের নবমী তিথিতে পালন করা হয় নবমী পূজা। এ বছর নবমী ও দশমী তিথি একই দিনে থাকায় শাস্ত্রীয় বিধান মেনে পূজার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হচ্ছে এবং বৃহস্পতিবারই মর্ত্য ছেড়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে ফিরে গেছেন দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা।
কেন্দ্রীয় পূজা কমিটি সূত্রে জানা গেছে, আজ শুক্রবার বিকেল ৩টায় রাজধানীর পলাশীর মোড়ে জড়ো করা হবে সব মূর্তি। বিকেল ৪টায় ঢাকেশ্বরী মন্দির এলাকা থেকে বিজয়া শোভাযাত্রা বের করা হবে। নগরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে শোভাযাত্রা শেষ হবে পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে। এর পর বুড়িগঙ্গায় মায়ের প্রতিমা বিসর্জন হবে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতেও রাজধানীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপে ছিল ভক্তদের ভিড়। শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে দেবী দর্শন চলছে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে স্বর্গলোক কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যে আসেন। চার সন্তান লক্ষ্মী, কার্তিক, সরস্বতী আর গণেশকে নিয়ে নির্দিষ্ট তিথি পর্যন্ত বাবার বাড়িতে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। দেবীর অবস্থানকালে এই পাঁচ দিন পৃথিবীর ভক্তরা ‘দেবী মা’র বন্দনা করেন।
ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের সহসম্পাদক এবং পূজার তন্দ্রধারক স্বামী স্থিরাত্মানন্দ মহারাজ (নিরঞ্জন মহারাজ) বলেন, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার ঘোড়ায় চড়ে কৈলাস থেকে মর্ত্যলোকে আসবেন। এতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রোগ-শোক, হানাহানি বাড়বে। অন্যদিকে কৈলাসে (স্বর্গে) বিদায় নেবেন দোলায় চড়ে। যার ফলে বিশ্বে মড়ক, ব্যাধি ও প্রাণহানির মতো ঘটনা বাড়বে।
এদিকে, রাজধানীসহ সারা দেশের প্রতিটি পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা রক্ষায় পুলিশ, আনসার, বিজিবি, র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি মণ্ডপে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দায়িত্ব পালন করছে। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির উদ্যোগে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারা দেশে ২৯ হাজার ৭৪টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হচ্ছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় মণ্ডপের সংখ্যা ২২২টি।
রাষ্ট্রপতির শুভেচ্ছা বিনিময় : দুর্গাপূজা উপলক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। বাংলাদেশে কোনো উৎসব ও পার্বণ কখনো ধর্মের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি মন্তব্য করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ধর্ম যার যার হলেও উৎসব সবার।
বৃহস্পতিবার বঙ্গভবনে বিজয়া দশমীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পূজার শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, ‘দুর্গাপূজা কিংবা অন্যান্য পার্বণ বাংলার শাশ্বত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গভীর থেকে উৎসারিত। তাই এসব উৎসব কখনো ধর্মের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি। ধর্ম সম্প্রদায়ের, কিন্তু উৎসব সর্বজনীন। ঐক্যবোধ আর ধর্মনিরপেক্ষতা এ দেশের মানুষের ধর্ম।’
দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিজয়ার শুভেচ্ছা জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, ‘সমাজে অন্যায়, অশুভ ও অসুর শক্তি দমনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ পূজা হয়। আবহমান কাল ধরে এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবমুখর পরিবেশে নানা উপাচার ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দুর্গাপূজা পালন করে আসছে। এ উৎসব সর্বজনীন। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এবং ধর্মের মূল বাণী আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে উদ্বুদ্ধ করুক।’
রাষ্ট্রপতি এ সময় ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ, নেপালের রাষ্ট্রদূত হরি কুমার শ্রেষ্ঠা, রামকৃষ্ণ মঠের অধ্যক্ষ স্বামী ধ্রুবেশানন্দ মহারাজসহ হিন্দু ধর্মীয় নেতা এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল, শিল্পী রথীন্দ্র নাথ রায় ও চিকিৎসক অরূপ রতন চৌধুরীও শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অন্যদের মধ্যে ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ছিলেন।