প্রবারণা পূর্ণিমার তাৎপর্য
প্রবারণার পালি শব্দ ‘পবারণা’। থেরবাদী বৌদ্ধ বিশ্বে আশ্বিনী পূর্ণিমাকে ‘প্রবারণা পূর্ণিমা’ বলা হয়। এ প্রবারণা পূর্ণিমা থেরবাদী বৌদ্ধদের কাছে একটি উল্লেখযোগ্য পূর্ণিমা। বৌদ্ধ ইতিহাসে এ পূর্ণিমার তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য অপরিসীম।
আজ ২৭ অক্টোবর ২০১৫ খ্রি. সেই মহিমান্বিত পবিত্র আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমা। ২৫৫৯ বুদ্ধাব্দের পূতপবিত্র প্রবারণা পূর্ণিমা। বিশ্বের অপরাপর থেরবাদী বৌদ্ধের মতো বাংলাদেশের সমতল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী মহাসাড়ম্বরে মহামহিমান্বিত পূতপবিত্র এ আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমাকে বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনসম্মত নানাবিধ বহু বর্ণিল অনুষ্ঠান সাজিয়ে প্রতিটি বৌদ্ধমন্দির ও প্যাগোডায় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে উদযাপন করার প্রয়াস পাচ্ছেন। উল্লেখ্য, করুণাঘন ভগবান বুদ্ধ বিশ্ব পরিবেশ সুসংরক্ষণ ও জনকল্যাণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার তাগিদে আষাঢ়ী পূর্ণিমার পবিত্র তিথিতে তাঁর শিষ্য ও শিষ্যা হিসেবে দীক্ষালব্ধ তাঁর অহিংস ধর্ম-দর্শনকে সার্বিক সুস্থিতিদানের লক্ষ্যে ও তাবৎ মানবজাতির মধ্যে মৈত্রী ও অহিংসার বাতাবরণে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিবেদিত, স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সুভাবিত চিত্ত ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সংঘকে তিন মাস বর্ষাব্রত অধিষ্ঠানপূর্বক নিজ নিজ বৌদ্ধমন্দির ও প্যাগোডায় অবস্থান করার বিধান প্রজ্ঞাপ্ত করেছিলেন।
আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে শ্রাবণী পূর্ণিমা হয়ে মধু পূর্ণিমা বা ভাদ্র পূর্ণিমা অতঃপর আজকের এ আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমা হলো বর্ষাব্রত অধিষ্ঠানের ব্যাপ্তিকাল। বুদ্ধের নির্দেশ হলো এই তিন মাস ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সংঘ নিরবচ্ছিন্নভাবে ধ্যান-ভাবনায় নিরত থাকবে। Insight meditation-এর মধ্য দিয়ে নিজ নিজ চিত্তের উৎকর্ষ বিধান করবে। প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সীমায় একত্রিত হয়ে অসাবধানতাবশত যদি কোনো ক্ষুদ্রানুক্ষুদ্র দোষত্রুটি জীবন চলার পথে সংঘটিত হয়ে থাকে, তা তাঁরা পারস্পরিক ‘আপত্তি দেশনা’র মাধ্যমে পরিশুদ্ধ থাকার অঙ্গীকারে অঙ্গীকারবদ্ধ হবে। তাঁরা ভিক্ষুসীমায় বসে ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ পাঠ বা দেশনা করবে। ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষে সন্নিবেশিত ২২৭ ভিক্ষুর অবশ্য-প্রতিপালনীয় শীলগুলোর মাহাত্ম্য পর্যালোচনাপূর্বক তাঁর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা অনুপুঙ্খ বুঝে নেবে বয়োজ্যেষ্ঠ স্থবির ও মহাস্থবির মহোদয়গণের কাছ থেকে। ভিক্ষুরা বর্ষার তিন মাস বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন গবেষণা করবে। প্রত্যেক অমাবস্যা পূর্ণিমা ও অষ্টমী তিথিতে সমাগত অষ্টশীল অধিষ্ঠিত উপোসথ ব্রতধারী পুণ্যপ্রত্যাশী ও দুঃখান্ত সাধনে বদ্ধপরিকর উপাসক-উপাসিকাদের উদ্দেশ্য বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের ওপর আকর্ষণীয় ভাষণের মাধ্যমে সদাসর্বদা তাঁদেরকে আত্মকল্যাণ, আত্মশুদ্ধিসহ পরকল্যাণব্রতে আত্মনিবেদিত থাকার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করবেন। বস্তুত প্রতিনিয়ত ধর্মশ্রবণ, সশ্রদ্ধচিত্তে ধর্মকে তথা সত্য ধর্মকে অন্তরের অন্তস্তলে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত রাখার মধ্য দিয়ে প্রতিটি নরনারী ও ভিক্ষু-ভিক্ষুণীর যাপিত জীবনের পরতে পরতে নিয়মনিষ্ঠভাবে সত্য ধর্মকে প্রতিপালনের একটি জীবনচক্র বির্নিমাণের লক্ষ্যেই করুণাঘন তথাগত বুদ্ধের বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান বিধানের একটি অনন্যসাধারণ মাঙ্গলিক প্রয়াস। কারণ তাঁর ধর্ম ‘শ্রবণ, ধারণ ও অনুশীলন’—এ তিনটি অপরিহার্য, অবিচ্ছেদ্য Component বা পারস্পরিক সহায়তাকারী গঠনশৈলীর ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল ও বিন্যস্ত।
এ পর্যায়ে এখানে প্রবারণা পূর্ণিমার তাৎপর্য ও ‘প্রবারণা’ শব্দটির অন্তর্নিহিত মাহাত্ম্য আলোচনার অবকাশ রাখে। এ প্রবারণা পূর্ণিমাতে থেরবাদী বৌদ্ধ বিশ্বের ভিক্ষু-ভিক্ষুণী সংঘ বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান সমাপ্ত করেন। অতঃপর এ পূর্ণিমা তিথিতেই করুণাঘন ভগবান বুদ্ধ তাবৎ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সংঘকে গ্রামে-গঞ্জে, নগর থেকে নগরান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে গিয়ে পুণ্যপ্রত্যাশী জাগতিক দুঃখ থেকে মুক্তির প্রত্যাশী নর-নারীর মাঝে তাঁর সত্যাশ্রয়ী, মৈত্রী ও অহিংসার মহামন্ত্রের আলোকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চিরন্তন রূপরেখায় আকীর্ণ ধর্ম-দর্শন প্রচার করার বিধান দেন। ভিক্ষু-ভিক্ষুণী ও গৃহী নির্বিশেষে সকরকে তা মেনে চলার নির্দেশ দেন।
করুণাঘন বুদ্ধ সারনাথের মৃগদাবে ‘ধর্মচক্র প্রবর্ত্তনের’ পর পঞ্চশিষ্য তাঁর নবাবিষ্কৃত ধর্ম-দর্শন পরিপূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করার মাধ্যমে দুঃখের মূলীভূত কারণ উপলব্দ হলে যশও তাঁর বন্ধুসহ বর্ষান্তে সর্বমোট ৬০ (ষাট) জন ধর্মজ্ঞানে অধিষ্ঠিত ভিক্ষুকে ধর্মপ্রচারে নিয়োজিত করেন। তিনি এভাবে নির্দেশ দেন ‘চরথ ভিক্খবে চারিকং বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়’—ভিক্ষুগণ, বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, লোকের প্রতি পরম অনুকম্পা পরবশ হয়ে দিকে দিকে এই কল্যাণ ধর্ম প্রচার কর। দুজন একদিকে যেও না। তাঁর নির্দেশে ‘বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়, লোকানুকম্পায়’ শব্দবন্ধসমূহকে বুকে ধারণ করে সমগ্র জীবজগতের কল্যাণার্থে আদি-মধ্য ও অন্তে কল্যাণযুক্ত ধর্ম বিতরণ করার জন্যে ভিক্ষুরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তারই ধারাবাহিতায় আজকের এ ২৫৫৯ বুদ্ধাব্দের আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমার পর থেরবাদী বৌদ্ধ বিশ্বের তাবৎ ভিক্ষুসংঘ প্রবারণার মধ্য দিয়ে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান পরিসমাপ্তির পরপরই ধর্ম প্রচারে বের হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। বস্তুত বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান পরিসমাপ্তির পরদিন থেকেই প্রতিটি বৌদ্ধ মন্দির ও প্যাগোডায় দানোত্তম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান শুরু হয়। যেসব মন্দির ও প্যাগোডায় ভিক্ষুসংঘ সাফল্যজনকভাবে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান সমাপ্ত করার পরাকাষ্টা প্রদর্শনের প্রয়াস পাবেন, সেসব মন্দির ও প্যাগোডায় পুণ্যার্থী দায়ক-দায়িকাদের দ্বারা ভিক্ষুসংঘের উদ্দেশ্য দানোত্তম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে সশ্রদ্ধচিত্তে ত্রিচীবর দান অত্যাবশ্যক। দায়ক-দায়িকাদের জন্য এ রূপ মহতী দানানুষ্ঠান সুসম্পাদন বিপুল পুণ্যদ্যোতক ও বটে। দানোত্তম শুভ কঠির চীবর দানানুষ্ঠান চলবে আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত দীর্ঘ এক মাস। একটি মন্দির ও প্যাগোডায় বছরে একবার মাত্র এ পবিত্র দানানুষ্ঠান সুসম্পন্ন বা আয়োজন করা যায়। এটি ও বুদ্ধের বিনয়ের একটি সুবিবেচনাপ্রসূত প্রজ্ঞাপ্ত বিধান।
এ পর্যায়ে এখানে প্রবারণা পূর্ণিমার ‘প্রবারণা’ হিসেবে বিধৃত শব্দটির তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য বিশ্লেষণের অবকাশ রাখে। পরম শ্রদ্ধেয় ‘শান্তরক্ষিত মহাথেরো’ মহোদয় কর্তৃক সংকলিত পালি বাংলা অভিধানে ‘পবারণা’ বা ‘প্রবারণা’ শব্দটির অর্থ উল্লেখিত রয়েছে যথাক্রমে নিমন্ত্রণ, আহ্বান, মিনতি, অনুরোধ, নিষেধ, ত্যাগ, শেষ, সমাপ্তি প্রভৃতি। তাই ‘প্রবারণ’ শব্দের অর্থ আশার তৃপ্তি, অভিলাষ পূরণ, শিক্ষার সমাপ্তি, অথবা ধ্যান শিক্ষার পরিসমাপ্তি বোঝায়। এখানে ‘প্রবারণা’ থেকে ‘প্রবারণ’ শব্দটি এসেছে। এখানে প্রবারণা হলো প্রকৃষ্টরূপে বারণ করা বিধায় ‘প্রবারণ’। অতএব, ‘প্রবারণা’ শব্দের আরো তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ হলো পরিতোষ, তৃপ্তি, সন্তুষ্টির বিষয়, ক্ষতিপূরণ, প্রায়শ্চিত্ত ও ঋণ পরিশোধ। অতএব, ‘প্রবারণা’ শব্দটি বারণ করা, নিষেধ করা, পরিত্যাগ করা, সমাপ্ত করা, অর্থে সমধিক প্রয়োগসিদ্ধ শব্দ হিসেবে বিবেচিত ও পরিগৃহীত।
বৌদ্ধ ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে, বুদ্ধ যখন শ্রাবস্তীর জেতবন মহাবিহারে অবস্থান করছিলেন, তখন কোশাল হতে একদল ভিক্ষু বর্ষাব্রত সমাপনান্তে বুদ্ধের সন্নিধানে উপস্থিত হয়েছিলেন। বুদ্ধ তাঁদেরকে বলেছিলেন, ‘ভিক্ষুসংঘ একস্থানে সম্মিলিতভাবে বসবাস করলে তাঁদের মধ্যে বহু বাদবিসংবাদ হওয়া অস্বাভাবিক নহে।’ বর্ষাবাস সমাপ্তির পর তোমরা অবশ্যই একত্র হয়ে ‘প্রবারণা’ করবে। পরস্পর পরস্পরের দোষত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং পরস্পরকে সত্যিকারভাবে বরণ করে নেবে। একস্থানে থাকার সময় পরস্পর পরস্পরকে অনুশাসন বা ক্ষেত্রবিশেষে ‘বারণ’ করলে উভয়ের পরম মঙ্গল সাধিত হয়। শাসন পরিশুদ্ধ হয়। এর ফলে সমগ্র ভিক্ষুসংঘের সার্বিক উন্নতি সাধিত হয়। ভিক্ষুসংঘের দ্বারা সাফল্যজনকভাবে ‘প্রবারণা’ উদযাপন সুসম্পন্ন হলে তাঁদের উদ্দেশ্যে পুণ্যার্থী দায়ক-দায়িকাদের দ্বারা দানোত্তম পবিত্র কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানের আয়োজন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কোনো বিহারে তিন মাস বর্ষাবাস উদযাপনপূর্বক কোনো ভিক্ষুর প্রবারণার আনুষ্ঠানিকতা সুসম্পন্ন না হলে সে বিহারে কঠিন চীবর দানের আয়োজন অসম্ভব বলে বুদ্ধ বিনয়ে বিধৃত রয়েছে।
বুদ্ধভাষা পালিতে বিধৃত এ ‘পবারণা’ শব্দটি খুবই গম্ভীর ও ব্যঞ্জনাময়। বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের ধারক বাহক ভিক্ষু-ভিক্ষুণীসহ ধর্মসংস্থাপনায় আত্মনিবেদিত বৌদ্ধ দায়ক-দায়িকাদের কাছে ‘পবারণা’ শব্দটির বহু ব্যঞ্জনাময় অন্তর্গূঢ় তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে বৌদ্ধিক চিন্তা-চেতনা, মন-মনন ও মননশীলতার প্রাণময় উৎসর্জন বর্তমান সময়ের যুগ-যন্ত্রণার প্রয়োজনে খুবই জরুরি। লাগামহীন লোভ-লালসার প্রবারণা, পরচর্চা, পরনিন্দা ও পর-ছিদ্রান্বেষণ তাড়িত বদ্কর্মসংস্কৃতিকে পরিপূর্ণভাবে প্রবারণ, অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত, বর্বরতম ও নৃশংসতম কর্মকাণ্ডসমূহ সর্বতোভাবে পরিত্যাগ বা প্রবারণ এবং তদ্স্থলে শুধু মানব নয়, গোটা প্রাণী-প্রজাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চেতনার আবাহন ও উৎসর্জন, বিশ্বব্যাপী অহিংসা ও মৈত্রীর স্পন্দমান (Vibrant) মাঙ্গলিক কর্ম-সংস্কৃতির ধারণ, কর্ষণ, লালন ও বাস্তবায়ন ২৫৫৯ বুদ্ধাব্দের শুভ আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমার সার্বিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে সৃষ্টির সেরা জীব মানব-মানবীর অন্তকরণে আবাহনের শঙ্খধ্বনি বাজুক—এ পবিত্র আশাবাদ ব্যক্ত করি।
লেখক : অধ্যক্ষ, আনন্দবিহার ও শাক্যমুনি বৌদ্ধবিহার, ঢাকা।