ঈদে মিলাদুন্নবীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য
আজ ১২ রবিউল আউওয়াল, ঈদে মিলাদুন্নবী (স.), বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর ১৪৪৫তম বেলাদাত ও ১৩৮৩তম ওয়াফাত দিবস। দিনটি সমগ্র বিশ্বেরে মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ২৯ আগস্ট, রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার, সূর্যোদ্বয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে, সুবহে সাদিকের সময় মহাকালের এক মহাক্রান্তিলগ্নে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আবার তেষট্টি বছরের এক মহান আদর্শিক জীবন অতিবাহিত করে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ৮ জুন, ১১ হিজরি রবিউল আউওয়াল মাসের ১২ তারিখ একই দিনে তিনি পরলোক গমন করেন। দিনটি মুসলিম সমাজে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (স.) নামে সমধিক পরিচিত। ঈদ, মিলাদ আর নবী তিনটি শব্দ যোগে দিবসটির নামকরণ হয়েছে। ঈদ অর্থ- আনন্দোৎসব, মিলাদ অর্থ- জন্মদিন আর নবী অর্থ নবী বা ঐশী বার্তাবাহক।
তাহলে ঈদে মিলাদুন্নবীর অর্থ দাঁড়ায় নবীর জন্মদিনের আনন্দোৎসব। ১২ রবিউল আউওয়াল একই সাথে মহানবীর জন্ম ও মৃত্যু দিবস হলেও তা শুধু জন্মোৎসব হিসেবেই পালিত হয়। পৃথিবীর যেকোনো মানুষের মুত্যুই তাঁর পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করে। কিন্তু মহানবীর মৃত্যু মানবসমাজ ও সভ্যতার কোনো পর্যয়ে কোনো শূন্যতার সৃষ্টি করেনি। যদিও তাঁর মুত্যুর চেয়ে অধিক বেদনাদায়ক কোনো বিষয় উম্মতের জন্য হতে পারে না। তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন সমগ্র পৃথিবীর জন্য আল্লাহর রহমত হিসেবে। এরশাদ হয়েছে, আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি । (সূরা আল-আম্বিয়া : ১০৭) এরশাদ হয়েছে, আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের জীবন বিধানকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার নেয়ামতরাজিকে পূর্ণতা দিলাম আর ইসলামকে তোমাদের একমাত্র জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম। (সুরা আল-মায়িদা ; ৩)
রবিউল আউওয়াল মাস এলে মুসলিম সমাজে মিলাদ মাহফিল ও সিরাত মাহফিল আয়োজনের ধুম পড়ে যায়। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (স.) যে আদর্শের সুষমা দিয়ে একটি বর্বর জাতিকে আদর্শ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো ফুটতে থাকা একটি সমাজকে শান্তির সুশীতল ছায়াতলে এনে দিয়েছিলেন; সেই মহান আদর্শে উত্তরণের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। মহানবীর আদর্শ অনুসরন না করে শুধু মিলাদ মাহফিল আর সিরাত মাহফিল আয়োজনে কোনো লাভ নেই। কারণ মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (স.)-এর আদর্শকে জীবনে ধারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসুল! আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাক তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু। (সুরা আল-মায়িদা : ৩১) রাসুলুল্লাহ (স.) চারিত্রিক শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমেই একটি শ্রেষ্ঠ জাতি গঠন করেছিলেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন নিশ্চয়ই আমি সর্বোত্তম চরিত্রের পূর্ণাঙ্গতা সাধনের জন্য প্রেরিত হয়েছি। (ইবনে মাজা) রাসুলুল্লাহ (স.)-এর আদর্শ ধারণ করেই সাহাবায়ে কেরাম (রা.) যুগের সর্বোত্তম মানুষ হতে পেরেছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন : সর্বোত্তম মানুষ হলো আমার যুগের মানুষ, অতঃপর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ, তারপর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ। (সহীহ বোখারি)
আজ আমাদের সমাজে মিলাদ-কিয়াম নিয়ে দ্বন্দ্ব আর দলাদলির শেষ নেই। রাসুলকে ভালোবাসার দাবিদার সবাই। কিন্তু এক পক্ষের প্রতি অন্য পক্ষের নিকৃষ্ট সব উক্তিতে রাসুলের প্রতি ভক্তি আর ভালোবাসার বিন্দুমাত্র চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। ভণ্ড, বিদায়াতি, ওহাবি, ফাসেক, কাফের বিভিন্ন আখ্যায় একে অন্যকে আখ্যায়িত করে ফেরকাবাজি আর সামাজিক বিভাজনকে বাড়িয়েই চলেছেন রাসুল প্রেমিকরা। মাঝেমধ্যে বিরোধ সংঘাতে গড়াচ্ছে এমনকি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের মতো জঘন্য ঘটনাও ঘটছে। যে রাসুল তাঁর জীবনে শত্রুর প্রতি কোনো দিন রুঢ়বাক্য নিক্ষেপ করেননি আজ তাঁর ভালোবাসার দাবি যে মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে সে মুখটাই অন্য মুসলমানের রক্তের পিপাসায় অধীর! হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসুলুল্লা (স.) বলেছেন : কোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকি আর তাকে হত্যা করা কুফরি। (বোখারি-মুসলিম) হজরত আবু জার গিফারি (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন যখন কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তির প্রতি ফাসেকি বা কুফরির অপবাদ নিক্ষেপ করে তখন অভিযুক্ত ব্যক্তি তার উপযুক্ত না হলে অপবাদ নিক্ষেপকারীর দিকে তার অপবাদ ফিরে আসে। (সহীহ বোখারি)
বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে ঈদে মিলাদুন্নবী (স.)-এর আগমন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (স.) গোত্রীয় শাসনের স্বৈরাচারে দগ্ধ, মুষ্টিমেয় বিত্তশালীর শোষণে নিঃস্ব, সামাজিক দূরাচারে অতিষ্ঠ মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তাওহিদের বাণী প্রচারের দায়ে স্বজাতির নির্যাতনে নিরুপায় হয়ে জন্মভূমি ছেড়ে মদিনায় হিজরতে বাধ্য হয়েছিলেন। অতঃপর ঐতিহাসিক মদিনা সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে ইহুদি, পৌত্তলিক, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের নিয়ে মদিনাতে একটি স্বাধীন-স্বতন্ত্র জাতি ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে রাসুলের আদর্শিক জাগরণ সমগ্র আরব উপদ্বীপকে আয়ত্ত্ব করে নিয়েছিল। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সুশাসন, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আজ যখন দেশের বিপুল মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে, যখন অন্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার অভাব জনজীবনে প্রকট হয়ে উঠছে, যখন মানুষ একে অপরের দ্বারা নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে— তখন ঈদে মিলাদুন্নবী (স.)-এর প্রতিপাদ্য বিষয় হোক রাসুলের ভালোবাসার দাবিতে সংঘাত নয়, চাই রাসুলের আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ।
লেখক : পেশ ইমাম ও খতিব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ।