বুদ্ধপূর্ণিমা
বুদ্ধের জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত হোক সকল প্রাণ
‘বুদ্ধপূর্ণিমা’ তিথিতে মহামানব বুদ্ধ লুম্বিনী উদ্যানে ‘জন্মগ্রহণ’, নৈরঞ্জনা নদীর তীরে অশ্বত্থ বোধিবৃক্ষমূলে ‘বুদ্ধত্ব’ লাভ এবং কুশীনগরের শালবনে ‘মহাপরিনির্বাণ’ লাভ করেছিলেন। সারা বিশ্বের সব বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা ‘বুদ্ধপূর্ণিমা’ শ্রদ্ধার সাথে উদযাপন করে, ধর্মোৎসবে মেতে ওঠে। বাংলাদেশেও এই পূর্ণিমা দিনটি সরকারি ছুটির দিন। এই বঙ্গদেশের প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় বুদ্ধপূর্ণিমা উদযাপিত হোক—এটাই প্রত্যাশা করি। ত্রিস্মৃতি বিজড়িত এই পুণ্যতিথি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। শুধু উদযাপনই সীমাবদ্ধ না রেখে চলমান জীবনেও এই পূর্ণিমার গুরুত্ব, তাৎপর্য এবং মহত্ব বহুল পরিমাণে উপলব্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে।
এই কথা মনে রাখতে হবে—তৃষ্ণার জাতাকলে পিষ্ট, দুঃখানলে কাতর, মিথ্যাদৃষ্টির বেড়াজালে আবদ্ধ সত্ত্বগণের জাগতিক দুঃখ মোচনের জন্য বুদ্ধ এই ধরায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি দিব্যসুখের ন্যায় রাজ্যসুখ ভোগ করার পরও, বৃদ্ধ-রোগী-মৃত-সন্ন্যাসী—এই চারটি নিমিত্ত দর্শনে গভীরভাবে উপলব্ধি করেন, জগতের কেউই এই সংসারের নিয়মের বাইরে নয়, সবই অনিত্য। শুধু নিজের নয়, সারা বিশ্বের জাগতিক দুঃখানলে পীড়িত প্রাণিকুলের মুক্তির জন্য সন্ন্যাসধর্ম অবলম্বন করে ছয় বছর দুষ্কর কঠোর সাধনা করার পর তিনি অশ্বথ বৃক্ষমূলে জন্ম ক্ষীণ করে বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হয়ে বিমুক্তি সুখ লাভ করেছিলেন।
তথাগত বুদ্ধ সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভ করে জানতে পারেন যে, জগৎ সংসারে জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মরণ দুঃখ, শোক-পরিতাপ-দৌর্মনস্য-হতাশা দুঃখ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ, প্রিয় বিয়োগ দুঃখ, যা ইচ্ছে করা হয় তা না পাওয়ার দুঃখ ইত্যাদি নানান দুঃখ-শোকে সত্ত্বগণকে যে পীড়িত হতে হয়, তার জন্য দায়ী হলো তৃষ্ণা। তৃষ্ণার উৎপত্তি হয় অবিদ্যার কারণে। অবিদ্যা ও তৃষ্ণাই সত্ত্বগণের পুনর্জন্ম ঘটায়, দুঃখানলে দগ্ধ করে থাকে।
এই কথা বলা যায়, যারা জন্ম ও মৃত্যুকে নিয়ে গভীর গবেষণা করেন, তারাই ভবদুঃখ সাগর পাড়ি দিতে পারেন। জন্ম-মৃত্যু বিষয়ে গবেষণা করলে “সর্ব সংস্কার ধ্বংসশীল”—এই কথাটা জীবনের প্রতিটি পদে পদেই উপলব্ধি করা যায়। আর এই উপলব্ধিবোধই মানুষকে অপ্রমত্তভাবে, অহিংস চিত্তে জীবনধারণে সচেষ্ট করে। সর্ব সংস্কার ধ্বংসশীল বা অনিত্য বলেই প্রতিটি মুহূর্তে এই দেহের রূপ-যৌবন প্রতিনিয়ত বিনষ্ট হচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের চিত্তেরও পরিবর্তন হচ্ছে, প্রতি ক্ষণে ক্ষণে চিত্ত বিষয় হতে বিষয়ান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, পশু-পাখি, গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, সমস্ত জড়চেতন পদার্থই প্রতিটি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে, কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয়।
জাগতিক এই পরিবর্তনশীলতা—ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত, সমাজে, রাষ্ট্রে সবখানে আমাদের গোচরে-অগোচরে নিত্যই পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবর্তনশীলতা বা অনিত্যবোধের অভাবেই মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে, সমষ্টিগত জীবনে, সমাজে, রাষ্ট্রে এতো হানাহানি, মারামারি, হিংসা-বিদ্বেষ, কলহ-বিচ্ছেদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে স্বামী-স্ত্রীর স্বভাবে, চরিত্রে, রুচিতে, ব্যবহারে পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক।
এই পরিবর্তনের জন্য পরস্পরের মধ্যে কলহ, ভুল বোঝাবুঝি হয় কিংবা মধুর সম্পর্ক তিক্ততায় পরিণত হয় ‘অনিত্যতা’ উপলব্ধি করতে না পারার জন্য। মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে হানাহানি, হিংসা, যুদ্ধও হচ্ছে অনিত্যতাবোধের অভাবের কারণে। যারা জন্ম-মৃত্যু নিয়ে গবেষণা করবেন কিংবা সংসারের অনিত্যতা উপলব্ধি করবেন তাঁরা প্রত্যক্ষ করবেন, জগতের কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয়, সবকিছুই ধ্বংসশীল, এই দেহ পর্যন্ত আমার নয়। তজ্জন্য তারা যেকোনো পরিবর্তনকে সহজেই মেনে নেবেন, সংঘাত বা বিচ্ছেদে জড়াবেন না, অহিংস চিত্তে অবস্থান করবেন।
বুদ্ধের আবিষ্কৃত অনিত্য জ্ঞানের চর্চা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। অনিত্যবোধ রাগ-দ্বেষ বিনাশের এবং মৈত্রীচিত্তে অবস্থান করার পক্ষে অত্যন্ত পক্ষে সহায়ক। অন্যদিকে মানবতার সাধনায়, মানুষে মানুষে ঐকতার জন্য বর্তমান পৃথিবীতে মৈত্রীচিত্তে সহাবস্থান একান্তই আবশ্যক। জাগতিক দুঃখ বিনাশের, মানুষে মানুষে ভাতৃত্ববোধ সৃষ্টির জন্য, মৈত্রী আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার জন্যই তো তথাগত বুদ্ধ এই ধরায় আবির্ভূত হয়েছিলেন, বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। সত্যিই! যিনি মৈত্রীর বাণী, অমৃত প্রেমের মন্ত্র সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর শূন্যতা আজকের হিংসাভরা পৃথিবীতে ভীষণ উপলব্ধি হচ্ছে।
সহজ কথায় বলতে গেলে, বৌদ্ধধর্মে মানুষের হৃদয়বৃত্তিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানুষের মধ্যে যে জ্ঞানশক্তি, ইচ্ছেশক্তি, কল্যাণশক্তি নিহিত রয়েছে, তা জাগ্রত করাই বৌদ্ধধর্মের প্রধান লক্ষ্য। মহামানব বুদ্ধ চতুরার্য সত্য জ্ঞান লাভ করে জাগতিক দুঃখের অন্তঃসাধন করতে সবসময় সচেষ্ট থাকতে বলেছেন। সত্য জ্ঞান লাভের বিষয়ে সুত্তন্তে বুদ্ধ বলেছেন, ‘সত্ত্বগণের বিশুদ্ধির নিমিত্তে, শোক ও বিলাপের বিনাশের জন্য, দুঃখ ও দৌমনস্য দূর করার জন্য, সত্য প্রাপ্তি ও নির্বাণ সাক্ষাৎকারের নিমিত্তে চারি স্মৃতিপ্রস্থান একমাত্র মার্গ।’ আবার মহামানব বুদ্ধ মৈত্রী-করুণা-মুদিতা-উপেক্ষা—এই চারটি বিষয়কে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়ে জীবনযাপন করতে বলেছেন।
এটি বৌদ্ধধর্মের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ ত্রিভুবনের সত্ত্বদের সমান গুরুত্ব তাঁর নিকট ছিল। করণীয় মৈত্রী সূত্রে বুদ্ধ বলেছেন, ‘মাতা যেমন স্বীয় গর্ভজাত একমাত্র পুত্রকে নিজের জীবন দিয়া রক্ষা করে, এরূপে সকল প্রাণীর প্রতি অপ্রমেয় মৈত্রীভাব পোষণ করবে।’ ধর্মপদে বুদ্ধ বলেছেন, ‘বৈরিতার দ্বারা বৈরিতা, শত্রুতার দ্বারা শত্রুতা কখনো প্রশমিত হয় না, অবৈরিতা ও মৈত্রীর দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়।’
বলা যায়, মহামানব বুদ্ধের বাণী জগতের অনিত্যতা জ্ঞান উপলব্ধি করতে শেখায়, আত্যন্তিক দুঃখের অন্তঃসাধন করে সত্ত্বগণকে পরম সুখ নির্বাণ প্রাপ্ত করায়, অপ্রমত্তভাবে জীবনধারণ করতে উৎসাহিত করে, মানুষে মানুষে মৈত্রী প্রেমের সেতুবন্ধনে আবদ্ধ করে। ত্রিস্মৃতি বিজড়িত বুদ্ধপূর্ণিমা দিনে এমনই হোক সবার উপলব্ধি। বুদ্ধের জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত হোক সকল প্রাণ।