রম্য
' শ্বশুর না স্ব-সুর?'
বিষয়টা আনিকার শ্বশুর জানতে পারলেন বিয়ের পর। আনিকা যে গান করে তা যদি বিয়ের আগে তিনি বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারতেন তাহলে কখনোই তার একমাত্র আদরের ছেলে তানিমকে এই বিয়ে করাতেন না। গান নিয়ে তানিমের বাবার আগে তেমন কোনো অভিযোগ ছিল না। বরং তিনি নিজেও গান প্রচণ্ড রকম ভালোবাসতেন। তবে গানের প্রতি তার ভালোবাসা টিকে ছিল বিয়ের আগ পর্যন্ত। তানিমের মাকে তার বাবা বিয়ে করেছিলেন একটা গুণ দেখেই, আর তা হলো গান গাইতে পারা। কিন্তু বিয়ের পর এই গানই যে তার জীবনে একটা দুঃসহ অধ্যায় রচনা করবে, তা কে বা জানত।
তানিম সাহেব যতটুকু জানতেন তা হলো তার সদ্য বিবাহিত বউ গান গাইতে পারে। কিন্তু তার জানা ছিল না যে বিষয়টি তা হলো তার বউ গান নিয়ে গবেষণাও করতে পারে। এক গানের কথা অন্য গানের সুরে লাগিয়ে, অন্য গানের সুর আরেক গানের কথায় লাগিয়ে তিনি নিত্যনতুন গানের উদ্ভাবন করেন। আর সেসব গানের শ্রোতা হতে হয় বেচারা তানিম সাহেবকে। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে তিনি তাঁর বউয়ের একমাত্র শ্রোতা। এই শ্রোতা হওয়ার যে তাঁর কোনো ইচ্ছেই নেই, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সেই কথা মুখ ফুটে বলার জো নেই। একবার গান শুনতে রাজি না হওয়ায় তাদের বাসায় টানা আটদিন কোনো রান্না হয়নি। অগত্যা বাধ্য হয়ে হোটেলের খাবার খেয়েই তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছিল। সেই থেকে তানিম সাহেবের শিক্ষা হয়েছে। তিনি মনে মনে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়েছেন- 'যত খারাপই শুনাক, বউয়ের গান আমি শুনবই। পৃথিবীর ইতিহাসে ভালোবাসার জন্য কতজনই তো তাদের প্রাণ ত্যাগ করেছেন, আমি না হয় আমার বউয়ের জন্য এই আত্মত্যাগ করলাম।'
বউয়ের গান গাওয়া ও গানের উপর গবেষণার ফলে তাঁর জীবন যেন ঠোঙ্গার শেষ কোণায় চিপায় পড়ে থাকা বাদামের মতো হয়ে গেছে। তাই তিনি মনে প্রাণে চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে যাতে এমন বউ পায়, যে গান থেকে ১০০ হাত দূরে থাকে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তানিমও গায়ক বউ পেল।
বিয়ের কয়েকদিনের মাথায়ই আনিকার সাথে তার শ্বাশুড়ির বেশ খাতির জমে গেল। তারা এখন দ্বিগুণ উৎসাহে গান চর্চা করে এবং গবেষণালব্ধ ফল হিসেবে যে সংকর জাতের গানের সৃষ্টি হয় তা একসাথে তানিম ও তানিমের বাবাকে শোনায়। বেচারা বাপ-বেটা মুখে কৃত্রিম হাসি লাগিয়ে তাদের গান শোনেন আর মনে মনে ভাবেন, 'ইশ, চোখের মতো যদি কানের পর্দাগুলোও প্রয়োজনের সময় বন্ধ করা যেত।'
শ্বাশুড়ি ও বউমার সুরসাধনার মাঝে এভাবেই কোনো রকমে বাপ-বেটার দিন চলছিল। একদিন তানিমের বাবা আনিকাকে সুযোগ বুঝে বলেই বসলেন, 'মা, তোমার শ্বাশুড়িকে তো বলার সাহস নেই, তাই তোমাকেই বলি। তোমাদের এই সুরসাধনা কিছুদিনের জন্য স্থগিত রাখা যায় না? এই ৪০ বছরে তোমার শাশুড়ির সুরে আমার হৃদপিণ্ড এমনিতেই আধমরা হয়ে গেছে। তোমাদের এই সুরসাধনা এভাবে চলতে থাকলে কোনদিন যে হৃদপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করে দেয়, তা নিয়েই ভয়ে থাকি সবসময়!' শ্বশুরের মুখে এমন কথা শুনে আনিকা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। আর মনে মনে বিড়বিড় করে বলে, 'কোনটা ছাড়ব, শ্বশুর না স্ব-সুর?'