রম্য
শিক্ষা সফর
ঢাকার নামী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে একজন রোগী এসেছেন।
এসেছেন মানে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে।
দুজন তাঁকে ধরে নিয়ে এসেছেন।
তাঁদের হাতে অনেক পলিব্যাগ।
রোগী একটু পরপর বমি করছেন।
সঙ্গের দুজন পালাক্রমে পলিথিন এগিয়ে দিচ্ছেন।
রোগী ওয়াক করলেই তাঁরা হাঁ করা পলিথিন নিয়ে রোগীর কাছে ছুটে আসছেন।
রোগী বমি করছেন।
বমি শেষ করে মুখে বলছেন, আমি কী খাইলাম রে . . . ওরে আমি কী খাইলাম রে . . .
সঙ্গের দুজন তার প্রশ্নের উত্তর দেয় না।
তাঁরা হয়তো জানেন না, তিনি কী খেয়েছেন। অথবা জানলেও এখন বলার সময় নয়।
পাশে দাঁড়ানো উৎসুক একজন আরেকজনকে বলছেন, মনে হয় বিষ খাইছে।
পাশেরজন বললেন, বিষ খাইলে কি কেউ বমি করে বেক্কল।
করে করে। বিষ খাইছে, সেইটা ধরা পড়লে যেইটা খাওয়ানো হয় সেইটা খাইলে করে।
কী?
কী আবার। গু। বিষ খাওয়া মাইনষের প্রথম চিকিৎসা হইল গু চিকিৎসা। ধইরা ১০০ গ্রাম কাঁচা গু খাওয়াইয়া দাও। এর ওপরে ওষুধ নাই। আমি নিশ্চিত, এই লোকরে গু খাওয়ানো হইছে। ওয়াক ওয়াক তার ফলাফল।
তিনি নিশ্চিত হলেও আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারি না।
নিশ্চিত হতে একজন গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ভাই, আপনি কী খেয়েছেন?
প্রশ্ন শুনে বমি করা লোকটার মুখের হাঁ আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। ওয়াক . . .
এবারের বমি তিনি কী খেয়েছেন, সেটা মনে করে।
সঙ্গের দুজন পলিথিন নিয়ে ছুটে আসেন।
কিন্তু এবারের পলিথিনথেরাপি ব্যর্থ হয়।
তাঁরা পৌঁছানোর আগেই ঘটনা ঘটে যায়।
তাঁরা বমি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
ঘটনা জানা যায় তৃতীয়জনের কাছ থেকে, যিনি কিছুক্ষণ পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।
তিনি একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান।
তাঁর হাতে পলিথিন নেই। মোবাইল ফোন আছে।
তিনি মোবাইল ফোনে সবাইকে ঘটনা জানাচ্ছেন।
...কী আর বলমু। কইতে কষ্টও লাগে। আর হাসনও আসে। সলিম মিয়া এইডা একটা কাম করছে... ও যে এত্তো বড় গর্দভ এইটা ইলেকশানের আগে টের পাইলে মানুষ ওরে ভোটই দিত না...
চেয়ারম্যান সাহেবের কাছ থেকে শোনা ঘটনাটা ঠিক এ রকম।
যিনি বমি করছেন, তিনি এসেছেন পঞ্চগড় থেকে। সেখানকার একটি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। বয়স পঁয়তাল্লিশের মতো। এবারই প্রথম মেম্বার হয়েছেন।
এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে এবারই প্রথম ঢাকায় এসেছেন। গত রাতে।
এলাকার কিছু বিষয় নিয়ে এমপি সাহেবের সঙ্গে দেনদরবার আছে।
তাঁরা উঠেছেন মাঝারি মানের একটি হোটেলে।
মেম্বার সাহেব এবারই প্রথম কোনো হোটেলে থাকছেন।
বাতাস যে এত ঠান্ডা হতে পারে, এসিরুমে বসে সেটা এবারই প্রথম টের পেয়েছেন।
বিছানার চাদর গায়ে জড়িয়ে বারবার বলেছেন, আমার হিম লাগে। উহুহু... হিম লাগে।
হোটেলে এবারই প্রথম দেখলেন কোনো বেটা ছেলে তাঁর প্লেটে ভাত বেড়ে দিচ্ছে। বাড়িতে এই কাজ তাঁর বউ অথবা বড় মেয়ে করে। আগে মা করত।
এই প্রথম তিনি দেখলেন, হোটেলে এই কাজ পোলারা করে।
তো, অনেক প্রথম ঘটনার মধ্যে তিনি আরেকটা কাজও প্রথম করলেন। যার ফলস্বরূপ এখন ওয়াক ওয়াক করছেন।
রাতটা ভালোভাবেই কেটেছে। খাওয়াটাও খারাপ ছিল না।
সমস্যা হয়েছে সকালবেলা।
বিদ্যুৎ বিপর্যয় এবং অন্য কিছু সমস্যার কারণে সকাল থেকেই হোটেলের কোথাও পানি ছিল না।
ওয়াক ওয়াক মেম্বার এ তথ্য জানতেন না।
তাঁর জানার কথাও নয়। গ্রামে তো আর এ সমস্যা নেই।
সেখানে পুকুরভরা পানি।
ঘুম থেকে উঠে ওয়াক মেম্বার বাথরুমে ঢুকে গেলেন।
চোখ-মুখ ধুলেন।
কুলিও করলেন বার কয়েক।
এরপর চেয়ারম্যানসহ বাকিদের সঙ্গে সকালের নাশতাও করলেন।
নাশতা শেষে চা-টা খাওয়ার পর তিনি যখন বাথরুমে যেতে চাইলেন, সমস্যা হলো তখন।
হোটেলের ওয়েটার বাথরুম করার জর্য তাঁকে যেখানটা দেখিয়ে দিল, সে জায়গাটা তার পরিচিত।
কিছুক্ষণ আগেই তো ওখানে জমে থাকা পানি দিয়ে তিনি মুখ ধুয়েছেন, কুলি করেছেন। হয়তো কিঞ্চিৎ পানও করেছেন। এখন ওখানেই তাকে ইয়ে করতে বলছে! ছোট-বড় দুটোই।
তিনি ধন্দে পড়ে গেলেন।
দৌড় দিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে এলেন।
চেয়ারম্যান সাব কী কয়!
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, ঠিকই তো আছে। এইটা তো আর গ্রাম-দ্যাশ না যে বদনা নিয়া গাছের ওপর উইঠা বসবি। শহরে এইটাই সিস্টেম। যা . . .
কন কী! তাইলে আমি আগে কী করছি!
কী করছস?
না। কিছু না।
মেম্বার বিষয়টা প্রকাশ করে না।
কিন্তু মাথা থেকে তাড়াতেও পারে না।
সে ঝিম মেরে থাকে।
কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকে সে পুরো ব্যাপারটা একবার চিন্তা করে। সে আসলে কী করেছে।
তার পর থেকে শুরু হয় ওয়াক... ওয়াক...
সঙ্গে থেকে থেকে, আমি কী খাইলাম রে... আমি কী খাইলাম রে...
আহারে, কত না বিচিত্রভাবে আমাদের শিক্ষা নিতে হয়।
আসলেই জানার কোনো শেষ নেই।
নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষা নিতে হয়।
সব সময় মধুর অভিজ্ঞতা হয় না।
কখনো কখনো সেটা তিক্তও হয়।
জীবন আসলেই একটি শিক্ষা সফর।