তারকা ফুটবলার নাদিয়া নাদিম এখন চিকিৎসকও
পাঁচ বছরের কঠিন শ্রমের ফল পেয়েছেন আন্তর্জাতিক ফুটবল তারকা নাদিয়া নাদিম। এবার তিনি চিকিৎসক হওয়ার পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উতরে গেছেন। তবে, চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছাপূরণের আগে নিজের আরও কয়েকটি স্বপ্নপূরণ করে ফেলেছেন নাদিয়া।
সংবাদমাধ্যম নাইনডটকম জানিয়েছে, তালিবানের রক্তচক্ষুর ভয়ে ১১ বছর বয়সে আফগানিস্তান থেকে পালানো মেয়েটি এখন ফুটবল মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এককালে ভুয়া পাসপোর্টে আফগানিস্তান ছাড়া উদ্বাস্তু মেয়েটিকে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ফুটবলার বলে মেনে নিয়েছেন অনেকে। অনেকে তো আবার ৩৪ বছরের নাদিয়াকে সর্বকালের সেরা আফগান নারী ফুটবলারের তকমাও দিয়েছেন।
ক্লাব বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফুটবল নিয়ে মাঠ কাঁপানোর পাশাপাশি ডাক্তারি পরীক্ষার পড়াশোনাও সমান তালে চালিয়ে গেছেন নাদিয়া। সে পরীক্ষায় পাস করার পর টুইট করে নাদিয়া ধন্যবাদ দিয়েছেন অগণিত শুভানুধ্যায়ীকে।
নাদিয়া লিখেছেন, ‘প্রথম দিন থেকে আমার পাশে থাকার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। চলার পথে যে সব নতুন বন্ধু পেয়েছি, তাঁদের সাহায্য ছাড়া এ সব সম্ভব হতো না। আমার ওপর ভরসা করার জন্য আপনাদের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’
বিপক্ষের কড়া রক্ষণ ভেদ করে গোলরক্ষককে বোকা বানানোর মতোই একসময় তালেবানকে বোকা বানিয়েছিলেন নাদিয়া। তখন তাঁর বয়স মাত্র এগারো। ওই বয়সেই কাবুলের দক্ষিণে হেরাত শহরে ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল নাদিয়ার পরিবার।
সময়টা ২০০০ সাল। এগারো বছরের নাদিয়া একদিন খবর পেল—তার বাবা রাবানি নাদিমকে তালেবান তুলে নিয়ে গেছে। সে সময় রাবানি ছিলেন আফগান সেনাবাহিনী কর্মকর্তা। সে দিনের পর বাবাকে আর দেখতে পাননি নাদিয়া। শুনেছিলেন, কোনো এক মরুভূমিতে বাবাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে তালেবান। এ খবর পেয়ে মেয়েদের নিয়ে ভিটে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন নাদিয়ার মা হামিদা। এরপর তালেবান জঙ্গিদের চোখ এড়িয়ে ভুয়া পাসপোর্টে দেশ ছেড়েছিলেন মা এবং চার বোনসহ নাদিয়ারা।
ভিটেমাটিসহ নিজেদের প্রায় সব কিছু বেচে ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে পাকিস্তান পৌঁছান নাদিয়ারা। সেখান থেকে ট্রাকে করে ইতালি। তারপর লন্ডন। শেষমেশ পা রাখেন ডেনমার্কে।
ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমে নাদিয়া বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তানে যুদ্ধ ছিল, যাতে বাবা খুন হয়েছিলেন। ওই স্মৃতিগুলো সুখের নয়, বেশ অশান্তির, আর বেশির ভাগই ভয়ের। আফগানিস্তানে আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত ছিল না।’
ডেনমার্কের একটি গ্রামে এসে এক শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই হয়েছিল নাদিয়াদের। ওই শিবিরের মাঠে ফুটবলের অনুশীলন করত ছোট ছোট মেয়েরা। আর কাঁটাতারের পাশে দাঁড়িয়ে তা-ই দেখতেন ছোট্ট নাদিয়া। তখন থেকেই ফুটবলের নেশা ধরে যায় তাঁর।
মেয়েদের খেলতে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর নাদিয়ার সে সময় মনে হয়েছিল, ‘আমাকেও এ মাঠে নামতে হবে। মনে হয়েছিল, আমি ফুটবলারই হতে চাই।’
একদিন শিবিরের ফুটবল কোচের কাছে নিজের ইচ্ছার কথাটা বলে ফেলেন নাদিয়া। কয়েক মাস অনুশীলনের পর তাঁর অভিষেক হয় ফুটবল মাঠে। নাদিয়ার কথায়, ‘হঠাৎ করেই আমার প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রস্তুতি ম্যাচ খেলছি, ড্রিল করছি... চার পাশে কী ঘটছে, তা বুঝতেই সময় লেগে গিয়েছিল। তবে, ভালো লাগছিল।’
এক সময় শরণার্থী নাদিয়াকে আশ্রয় দেয় ডেনমার্ক সরকার। এর পর আর তাঁকে পেছনে তাকাতে হয়নি। পেশাদার ফুটবলার হিসেবে ২০০৫ সালে ডেনমার্কের প্রথম শ্রেণির ক্লাব বি৫২ আলবর্গ দলের জার্সি পরেন নাদিয়া। ওই বছরের শেষে টিম ভাইবর্গে যোগ দেন। এরপর প্রায় ১০ বছর ডেনমার্কের একাধিক ক্লাবে খেলেছেন নাদিয়া। সব দলেই তিনি ছিলেন দলের নির্ভরযোগ্য স্ট্রাইকার।
এর পরের ঘটনা আরও চমক জাগানিয়া। ২০০৯ সালে ডেনমার্কের জাতীয় দলের জার্সিতে মাঠে নামেন নাদিয়া। নাদিয়াই ডেনমার্কের প্রথম ফুটবলার যিনি জন্মসূত্রে ডেনিশ নন। ডেনমার্কের হয়ে ৯৯ ম্যাচে ৩৮টি গোল করেছেন নাদিয়া।
২০১৪ সালে নাদিয়া যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান স্কাই ব্লু এফসি ক্লাবের হয়ে খেলতে। এর পরের বছর ধারে তাঁকে নিয়ে নেয় পোর্টল্যান্ড থর্নস।
২০১৮ সালে আসে নাদিয়ার ক্লাব ফুটবল ক্যারিয়ারের সোনালি অধ্যায়। ওই বছর উইমেন্স সুপার লিগে ম্যানচেস্টার সিটি’র জার্সি পরেন নাদিয়া।
ম্যানসিটিতে বছরখানেক কাটিয়ে ২০১৯ সালে প্যারিস ক্লাব সঁ জঁ-তে যোগ দেন নাদিয়া। সহঅধিনায়কও হন। সঁ জঁ-তে থাকাকালে ওই ক্লাবের ইতিহাসে প্রথম বার লিগ খেতাব জিতে নেয় তাঁর দল। ওই মৌসুমে ২৭ ম্যাচে ১৮ গোল এসেছিল নাদিয়ার পা থেকে।
গত বছরের জুনে মার্কিন লিগ ফুটবলে রেসিং লুইভিল ক্লাবে চলে গেছেন নাদিয়া।
পায়ের নিপুণ কাজে বল লক্ষ্যে নিতে দক্ষ নাদিয়া খেলার মধ্যেই নিয়েছেন চিকিৎসক হওয়ার পরীক্ষার প্রস্তুতি। এর মধ্যেই নাদিয়া প্রায়ই সরব হয়েছেন আফগানিস্তানের নারী ও শিশুকন্যাদের অধিকার রক্ষার দাবিতে।
আফগানিস্তানের নারী ও মেয়েশিশুদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে গত বছর জাতিসংঘসহ নানা স্থানীয় সংগঠনের হয়ে ২৯ হাজার পাউন্ড তোলায় সাহায্য করেন নাদিয়া। তালেবানি শাসনে জন্মস্থানের মেয়েরা যে ভয়ের পরিবেশে বাস করছেন, তা নিয়েও বরাবরই সরব হয়েছেন এ আন্তর্জাতিক তারকা ফুটবলার।