বাংলাদেশের সেই ঐতিহাসিক জয়
‘বাংলাদেশের মানুষের উচ্ছ্বাস কোনো কিছু দিয়ে রোখা যাবে না। এটা ছিল তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা দিন। সম্ভবত স্বাধীনতার পর আর কোনো ঘটনা গোটা দেশকে এভাবে আনন্দ দিয়ে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি।’ কথাগুলো লেখা হয়েছিল ক্রিকেটের বাইবেল-খ্যাত উইজডেনে—১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ের পর।
১৯৭১ সালে যাদের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ, ইংল্যান্ডের মাটিতে সেই পাকিস্তানকে হারিয়েই ক্রিকেট-অঙ্গনে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে আজও ওই ম্যাচকে অন্যতম অঘটন ধরা হয়। কোনো টেস্ট দলের বিপক্ষে পাওয়া প্রথম জয় বাংলাদেশকে টেস্ট মর্যাদাপ্রাপ্তির পথেও এগিয়ে দিয়েছিল অনেকখানি।
১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তান ছিল অন্যতম ফেভারিট। প্রথম চার ম্যাচ জিতে সুপার সিক্স নিশ্চিত করে ফেলা ওয়াসিম আকরামের দলের জন্য বাংলাদেশের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচটির তেমন গুরুত্ব ছিল না।
তবু বাংলাদেশ যে পাকিস্তানকে হারিয়ে দেবে, তা বোধহয় কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। সেই ম্যাচে পাকিস্তান দলটির দিকে তাকালে বিস্ময় বেড়ে যায় আরো। আকরামের নেতৃত্বে সেদিন খেলেছিলেন সাঈদ আনোয়ার, শহীদ আফ্রিদি, ইজাজ আহমেদ, ইনজামাম-উল-হক, সেলিম মালিক, আজহার মেহমুদ, মঈন খান, সাকলায়েন মুশতাক, ওয়াকার ইউনিস ও শোয়েব আখতার। অন্যদিকে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের অধিনায়কত্বে বাংলাদেশের ৬২ রানের ঐতিহাসিক জয়ে সঙ্গী হয়েছিলেন শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ, মেহরাব হোসেন অপি, আকরাম খান, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, খালেদ মাহমুদ সুজন, খালেদ মাসুদ পাইলট, মোহাম্মদ রফিক, নিয়ামুর রশীদ রাহুল ও শফিউদ্দিন আহমেদ বাবু।
আগের চার ম্যাচের কোনোটিতে ২০০ রানও করতে পারেনি বাংলাদেশ। এমনকি স্কটল্যান্ডের বিপক্ষেও না। কিন্তু নর্থহ্যাম্পটনে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে আকরাম-ওয়াকার-শোয়েব-সাকলায়েনদের নিয়ে গড়া দুর্দান্ত বোলিং আক্রমণের সামনে বুক চিতিয়ে লড়াই করে নয় উইকেটে ২২৩ রান করে বাংলাদেশ।
শুরুটাও ভালো হয়েছিল। ১৫.৩ ওভার স্থায়ী উদ্বোধনী জুটিতে ৬৯ রান এনে দিয়েছিলেন শাহরিয়ার (৩৯) ও মেহরাব (৯) । সেই ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে দলীয় সর্বোচ্চ ৪২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন আকরাম খান। অধিনায়ক বুলবুল (১৫), নাঈমুর (১৩), মিনহাজুল (১৪), খালেদ মাহমুদ (২৭), খালেদ মাসুদরাও (অপরাজিত ১৫) যথাসাধ্য চেষ্টা করে দলকে এনে দিয়েছিলেন লড়াই করার মতো সংগ্রহ। তবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪০ রান এসেছিল প্রতিপক্ষের বোলারদের সৌজন্যে-অতিরিক্ত থেকে।
পাকিস্তানের জন্য ২২৪ রানের লক্ষ্য খুব কঠিন কিছু ছিল না। কিন্তু ১৯৯৯ সালের ৩১ মে সবকিছুই যে ছিল বাংলাদেশের পক্ষে! ৪২ রানের মধ্যে আফ্রিদি-ইজাজ-আনোয়ার-ইনজামাম-মালিককে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে যায় ’৯২-এর বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। পাঁচজনের কেউই দুই অঙ্কের ঘরে যেতে পারেননি।
ষষ্ঠ উইকেটে ৫৫ রানের জুটি গড়ে দলকে কক্ষপথে ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন আজহার মেহমুদ ও আকরাম। কিন্তু দলীয় ৯৭ রানে মেহমুদ ও ১০২ রানে আকরামের বিদায়ের পর হার এড়াতে পারেনি পাকিস্তান। ৪৫তম ওভারে সাকলায়েনের রান আউটে পাকিস্তানের ইনিংসের সমাপ্তি আনন্দে ভাসিয়ে দেয় বাংলাদেশের মানুষকে। ব্যাট হাতে ২৭ রানের পর আফ্রিদি, ইনজামাম ও সেলিম মালিকের উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কার পান খালেদ মাহমুদ। সেদিন তাঁর বোলিং ফিগারও ছিল দেখার মতো, ১০-২-৩১-৩।
ম্যাচ শেষে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়ে ওয়াসিম আকরাম বলেছিলেন, ‘ছোটভাইয়েরা আমাদের হারিয়েছে বলে ভালো লাগছে।’ আর বাংলাদেশের অধিনায়ক বুলবুল যেন অবতীর্ণ হয়েছিলেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টার ভূমিকায়, ‘আমরা আজ ইতিহাস গড়েছি। বিশ্বের অন্যতম সেরা দল পাকিস্তানের বিপক্ষে এই জয় আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তি আর তরুণ খেলোয়াড়দের এগিয়ে যাওয়ার পথে সহায়ক হবে।’
সত্যিই বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। পরের বছরই এসে যায় কাঙ্ক্ষিত টেস্ট মর্যাদা। আর বাংলাদেশের ক্রিকেটও যাত্রা শুরু করে সম্ভাবনাময় নতুন দিনের পথে। আজ সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাশরাফিরা বুলবুলের ভবিষ্যদ্বাণীরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশও আজ বিশ্বক্রিকেটের এক সমীহ জাগানো শক্তি।