স্মরণ
জুয়েলের রুপার চেইন, হীরার গ্লাভস
‘জয় বাংলা’ শুধুই কি এক শব্দযুগল? অভিধানের পাতা উল্টিয়ে অর্থ খুঁজে বেড়ালে হয়তো তাই। কিন্তু বাঙালির কাছে তার চেয়ে বেশি কিছু। ‘জয় বাংলা’ উচ্চারিত হয়েছে বাঙালির স্বাধীনতা-সংগ্রামে। ধ্বনিত হয়েছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে। ‘জয় বাংলা’ এখনো বাঙালির চেতনায়। বাঙালির স্বাধীনতায়। বাঙালির বিজয়ে।
কিন্তু ‘জয় বাংলা’ এই শব্দাস্ত্র কবে থেকে বাঙালির হয়ে গেল? বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে। ষাটের দশকের শেষ ও সত্তর দশকের শুরুতে ওই শব্দাস্ত্রে কেঁপে উঠল পাকিস্তানি শাসকের অন্তরাত্মা। একাত্তরে ওই ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শুনতে শুনতেই পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করল। দেশ হানাদারমুক্ত হলো।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর বাঙালির বিজয়ের আগেই ‘জয় বাংলা’ ঢুকে পড়েছিল তার ক্রিকেটে! কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা শব্দটা যেভাবে আমাদের হলো’ কবিতার ভাবার্থ ধার করে লিখতে ইচ্ছে করে, ‘জয় বাংলা’ শব্দটা যেভাবে আমাদের ক্রিকেটে ঢুকে পড়ল। সেটা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আগে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার আগে। তবে সেটাও ১৯৭১ সালেই।
বাঙালি তখন আশায় বুক বেঁধেছিল, পাকিস্তানের ক্ষমতা তাদের হাতে আসবে। সত্তরের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় তাদের। কিন্তু জানুয়ারি যায়, ফেব্রুয়ারি যায় যায়, ক্ষমতা বাঙালির হাতে আসে না। উত্তাল বাঙালি। সেই সময় ঢাকায় আয়োজন করা হয় পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড একাদশ ও ইন্টারন্যাশনাল একাদশের মধ্যে চার দিনের ম্যাচ।
সেই ম্যাচে বাঙালি ক্রিকেটার ছিলেন একজন। এ এস এম রকিবুল হাসান। ১৮-১৯ বছরের এক যুবক। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড একাদশের হয়ে মাঠে নামছেন। কিন্তু প্রতিনিধিত্ব করছেন গোটা বাঙালি জাতির। ক্রিকেট মাঠেও বিস্ফোরণোন্মুখ বাঙালির মুখ রকিবুল। তাঁর ব্যাটে লাগান হলো ‘জয় বাংলা’ স্টিকার। ব্যাটে রান পাননি রকিবুল। কিন্তু বাঙালির মন পেয়ে গেলেন। জয় বাংলা ঢুকে পড়ল বাঙালির ক্রিকেট আঙিনায়। আর সেই আঙিনা থেকেই বিশ্ব দেখল বাঙালির অগ্নিঝরা মার্চ!
জানুয়ারি যায়। ফেব্রুয়ারি যায়। মার্চ আসে। কিন্তু এলো না বাঙালির ক্ষমতা। উল্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য সংসদ অধিবেশন বাতিল করলেন। বাঙালির বুঝতে বাকি থাকল না, খলের ছলের অভাব হয় না। দ্রোহে-ক্ষোভে ফেটে পড়ল বাঙালি। কিসের ক্রিকেট! কিসের ম্যাচ। বাঙালির ক্ষোভের আগুনে পুড়ল ঢাকা স্টেডিয়ামের বাউন্ডারি লাইনের দড়ি। পুড়ল গ্যালারির শামিয়ানা। গ্যালারি থেকে মিছিল বেরিয়ে পড়ল গোটা শহরে। রকিবুলের ব্যাটের সেই ‘জয় বাংলা’ বাঙালির মুখে মুখে। সব মিলিয়ে উত্তাল মার্চের প্রথম দিন।
অগ্নিঝরা মার্চের ৭ তারিখে বঙ্গবন্ধু জনসমুদ্রে আহ্বান জানালেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।’ হাতের ব্যাট ফেলে রেখে আবদুল হালিম চৌধুরী, ক্রিকেট মহলের জুয়েল প্রস্তুত হলেন স্টেনগান হাতে নিয়ে। শুরু হলো বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। প্রাণভয়ে ঢাকা ছেড়ে কাতারে কাতারে মানুষ ছুটছে গ্রামে। সীমান্ত পেরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে। ছুটলেন জুয়েল। নাম লেখালেন মুক্তিযুদ্ধে। ঢাকায় একের পর এক অপারেশন। এক একটা সফল অপারেশনের পর ইস্কাটনে আজাদদের বাড়িতে বন্ধুরা মিলে তা উদযাপন।
আগস্টের এক বিকেলে ইস্কাটনে জুয়েলের বন্ধু-টিমমেট সৈয়দ আশরাফুল হকদের বাসায় এলেন উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান শফিকুল হক হীরা। তিনি তখন ব্রিটিশ টি কোম্পানি লিপটন-এ চাকরি করেন। ইস্ট পাকিস্তানের উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান এবং একই সঙ্গে দলের ভাইস ক্যাপ্টেন। হীরার বদলি চিঠি এসে গেছে। কিন্তু তিনি দোদুল্যমান। ঢাকা থেকে করাচি যাবেন কি না। তাই এসেছিলেন তাঁর টিমমেট-বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করতে।
‘চিটাগং থেকে টি এক্সপোর্ট বন্ধ হয়ে গেছে। কোম্পানি অর্ডার দিল করাচি যেতে। কী করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একদিন দুপুরের পর ইস্কাটনে আশরাফুলদের বাসায় গেলাম। দেখি জুয়েল-আজাদ ওরা সবাই ওপরের একটা রুমে। আমি বললাম, কী করব এখন? জুয়েল বলল, ঠিক আছে হীরা ভাই, আপনি করাচি যান। আপনি ক্রিকেটার। আপনাকে ওরা কিছু বলবে না। আর শোনেন, আপনার ব্যাট-প্যাড-গ্লাভস আমাকে দিয়ে যান। বলেই দুইশ টাকা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমি বললাম, টাকা দিয়ে কী করব! আরে আমি তো বারোশ টাকার মতো বেতন পাই। জুয়েল বলল, না আমি আপনার গিয়ার্স কিনেই নেব। বলে জোর করে টাকাটা ধরিয়ে দিল। ওটাই ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। যাওয়ার সময় বলেছিলাম, জুয়েল, কাজটা কি তুমি ঠিক করলে? আমি চাকরি করি। তা ছাড়া আমি তোমার ভাইস ক্যাপ্টেন। ও বলেছিল, হীরা ভাই, আপনার গ্লাভস পরে আমি কিপিং করব। ওটা বিনা পয়সায় নেব কেন?’ ৪৫ বছর আগের এক পড়ন্ত বিকেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রীতিমতো আপ্লুত বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক হীরা। নিজের একখানা বই যাঁদের নামে উৎসর্গ করেছেন, সে তালিকায় সবার ওপরে তিনি রেখেছেন জুয়েলকে।
‘অসম্ভব সাহসী ব্যাটসম্যান ছিল জুয়েল। আর প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাবোধ ছিল ওর।’ নিজের টিমমেট সম্পর্কে ছোট্ট করে বললেন শফিকুল হক হীরা।
আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগলে জুয়েল কাউকে ছাড় দিত না, সে যে-ই হোক। শহীদ জুয়েল সম্পর্কে এ রকম মূল্যায়ন তাঁর আরেক সিনিয়র টিমমেট এবং একই অফিসে যাঁর সঙ্গে চাকরি করতেন, সেই ইব্রাহিম সাবেরের, ‘ও এপ্রিলেই মুক্তিযুদ্ধে নেমে পড়ে। আমি একদিন দেখলাম, ওর হাতের কনুইয়ের চামড়া উঠে গেছে। ওকে বললাম, জুয়েল, হাফশার্ট পরে আর অফিসে আসবে না। ওরা তোমাকে ধরে ফেলবে। তুমি ফুলস্লিভ পরবে। তার পর একদিন বলল, সাবের ভাই, এবার শিপমেন্টে আমার সময় লাগবে। আমরা তখন খুলনা থেকে নিউজপ্রিন্ট এক্সপোর্ট করতাম। ও ছিল শিপমেন্টের দায়িত্বে। বুঝলাম, ও অপারেশনে যাবে। বললাম, ঠিক আছে। তারপর আর দেখা হলো না। বাকিটা তো...!’ একাত্তর পেরিয়ে যাওয়া ইব্রাহিম সাবেরের গলা এমনই জড়ানো। সেটা আরো বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আরো অস্পষ্ট। আরো এলোমেলো।
কিন্তু জুয়েলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলেছেন যিনি, জুয়েলের খেলা ম্যাচ কাভার করেছেন যিনি, সেই প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের গলা সপ্তমে চড়ে গেল জুয়েলের প্রসঙ্গ উঠতেই, ‘জুয়েল, বিশ্বাস করতে পারবে না তোমরা, ও কী সাহসী ব্যাটসম্যান ছিল। হুক-পুল অসম্ভব ভালো খেলত। ইস্ট পাকিস্তান দলে ওর চেয়ে ভালো ওপেনিং ব্যাটসম্যান আমি তো দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর ওকে নিয়ে একটা ফিচার লিখেছিলাম। ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। ওর মা, বোন গুমরে গুমরে কাঁদছিল। খুব খারাপ লেগেছিল নিজের।’ তবে এখন সেই কামরুজ্জামানের আরো খারাপ লাগে। যখন দেখেন মিরপুর স্টেডিয়ামে শহীদ জুয়েলের নামে একটা স্ট্যান্ড আছে, যার কোনো নামফলক নেই। নেই তাঁর কোনো ছবি। বিজয় দিবস এলে শহীদ জুয়েল-শহীদ মুশতাক নামে একটা প্রদর্শনী ম্যাচ হয়। যাঁরা খেলেন, তাঁরাও জানেন না শহীদ জুয়েল কত বড় ব্যাটসম্যান ছিলেন। কত সাহসী যুবক ছিলেন। কতটা আত্মমর্যাদা নিয়ে তিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন।
‘আত্মমর্যাদা ছিল। কিন্তু মোটেও ঈর্ষাকাতর ছিলেন না। ইস্ট পাকিস্তান দলে তাঁর জায়গায় আমি সুযোগ পেয়েছিলাম। একাদশ ঘোষণার পর তিনিই আমাকে এসে বললেন, আরে তুমি তো প্র্যাকটিস করোনি। চলো নেটে। আমি তোমাকে বল করব। ভাবতে পারেন, কী স্পিরিট নিয়ে তিনি ক্রিকেট খেলতেন!’ বক্তার নাম রকিবুল হাসান। জুয়েলের দেশপ্রেম আর আত্মমর্যাদার প্রশ্ন তুলতেই যিনি বললেন, ‘স্যালুট। আমি তাঁর রুমমেট ছিলাম। করাচিতে খেলতে গিয়েছিলাম আমরা কায়েদ-ই-আযম ট্রফিতে। জুয়েলের খুব শখ ছিল গলায় মোটা রুপার চেইন পরা। করাচিতে একটা জুয়েলারি দোকানে গিয়েছিলেন চেইন কিনতে। উর্দুটা ভালো বলতে পারতেন না। দোকানদার তাঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল। রুমে ফিরে আমাকে বললেন। আমাদের এক বন্ধুর বাবা তখন ব্রিগেডিয়ার। আমরা তাঁকে ঘটনাটা বললাম। তিনি বললেন, তোমরা আমার জিপে ওঠ। দোকানটা দেখিয়ে দেবে শুধু। তাই করেছিলাম। বাকিটা বুঝতেই পারছেন। জুয়েল খুব খুশি। পরে করাচি থেকে আমাকে মোটা একটা রুপার চেইন কিনে দিয়েছিলেন। আজও আমি ভুলতে পারি না।’ সোনার এক দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে গেলেন জুয়েল। কিন্তু তাঁর দেওয়া রুপার চেইনটা এখনো বড় পোড়ায় রকিবুলকে।
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে বিজয়ী বাঙালির কাছে একে একে ফিরে আসে সবই। শুধু ফেরে না কিছু মানুষ। কিছু প্রাণ। সমষ্টিগত ‘শহীদ’ শব্দে যাঁরা বেঁচে আছেন।
বাঙালির ক্রিকেটের হারিয়ে যাওয়া জুয়েল ফেরেনি। জুয়েলদের মৃত্যু আলিঙ্গনের মধ্যে পাওয়া বাঙালির ক্রিকেট আঙিনা আজ বারবার মেতে ওঠে জয়ের আনন্দে। শুধু স্মৃতি হয়ে থাকে জুয়েলের কেনা হীরার গ্লাভস। রকিবুলকে কিনে দেওয়া রুপার চেইন!
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি