ফেসবুকে আপনার ফেস কেমন?
ফেসবুক কি মোবাইল ফোন কিংবা ঘড়ির মতো নিত্যব্যবহার্য কোনো যন্ত্র! ফেসবুক ছাড়া অনেকের হয়তো একদিনও চলে না। আবার কারো কারো সপ্তাহে বা মাসে একবার বা মাঝে মাঝে ব্যবহার করলেও চলে। ফেসবুকের মতো অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম যেমন টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, মাইস্পেস এসব সুপরিচিত ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত সাইটগুলো আপনাকে স্থান-কাল এবং তথ্য সংরক্ষণ ও আদান-প্রদানের একটি পরিবেশ (Platform) তৈরি করে দেয়। যেখানে মানুষ নিজের পরিচিতি নিয়ে অবস্থান করে, নিজের মতামত প্রকাশ করে, অন্যের বিষয়ে নিজের মতামত দেয়, ব্যক্তিগত ভালো লাগা মন্দ লাগা প্রকাশ করে, নিজের সাফল্য-ব্যর্থতার কথা, আনন্দ-বেদনার অনুভূতি প্রকাশ করে। আবার ফেসবুকের অন্যরকম ব্যবহারও হয়। কোনো বিষয় সাধারণ মানুষের মত বা ভোট গ্রহণ করা, কোনো অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করা, কোনো সামাজিক সহায়তামূলক কাজে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, কোনো অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করা। আবার ব্যবসায়িক ভিত্তিতে পণ্য বা সেবাদান ও প্রচারকাজেও আজকাল ফেসবুক ব্যবহৃত হচ্ছে।
ফেসবুকের ভালো দিক যেমন আছে, তেমনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর খারাপ প্রভাবও পড়ছে। এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় অবশ্য সেগুলো নয়। ফেসবুকে একজন মানুষের উপস্থিতি, তার পরিচয়, ব্যক্তিত্ব, তার মন-মানসিকতা, রুচি, আদর্শের প্রকাশ পায়। ভেবে দেখুন যখন ফেসবুক ছিল না তখন টেলিফোনে, ঘরোয়া অনুষ্ঠানে, বন্ধুদের আড্ডায়, সামাজিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মানুষের দেখা হতো, কথাবার্তা হতো, সেগুলো এখনো হয়। ঠিক এই আঙ্গিকে ফেসবুক একটি ভার্চুয়াল জগৎ যেখানে কম্পিউটারের মাধ্যমে আপনি মনিটর স্ক্রিনে অন্যদের উপস্থিতি কথাবার্তা জানতে ও জানাতে পারেন। সেখানে আপনার আচরণ, ব্যবহৃত শব্দ, কথা, মতামত বা আবেগের প্রকাশ আপনার ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরে। ফেসবুক ওয়ালে বন্ধুদের কোনো পোস্টে কিছু কিছু মানুষ মাঝে মাঝে খুবই অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে মতামত দেন। তিনি হয়তো বুঝতেও পারেন না তিনি যদিও কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছেন, তাঁর কথা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর তালিকায় থাকা বন্ধুদের মধ্যে। তিনি হয় তো বাড়িতে অনুজদের কাছে আদর্শস্থানীয়, অফিসের কলিগদের কাছে শ্রদ্ধেয় কিন্তু ফেসবুকের সবাই দেখল তিনি কত অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে কথা বলতে পারেন। এভাবে আপনার অজান্তেই আপনার চরিত্রের খারাপ দিকটি সবার কাছে উন্মুক্ত হয়ে যেতে পারে।
অনেকে সারা দিন বা দীর্ঘ সময় ধরে ফেসবুকের সামনে বসে থাকেন। প্রয়োজনে থাকতেই পারেন। কাউকে জিজ্ঞাসা করা উনি জেগে না ঘুমিয়ে, আজ অফিসে গেছেন কি না, দুপুরের খাবার খেয়েছেন কি না এসব আপনার ওয়ালে কাউকে উদ্দেশ্য করে লিখলে যাকে বলছেন উনি হয়তো দেখছেন বা উত্তর দিচ্ছেন। কিন্তু আপনার বন্ধুদের যাদের প্রয়োজন নেই তাদেরও নোটিফিকেশনটি দেখতে হচ্ছে। অনেক পেশাজীবী মানুষকে দেখা যায় আমি অফিসে যাচ্ছি, অফিসে চা পর্ব চলছে, আজ বাইরে লাঞ্চ করব, এতটা সময় টিভিতে নিউজ পড়ব, অফিসে মিটিং চলছে এই জাতীয় দৈনন্দিন কাজের বিষয় স্ট্যাটাস দিতে যার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আপনার বন্ধুরা জানেন আপনি কোথায় কী পেশায় আছেন। আপনার পেশাগত কাজ, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কাজকর্ম আপনার দৈনন্দিন জীবনের অংশ। ভেবে দেখুন প্রতিদিন অথবা দিনে কয়েকবার এগুলো বলতে থাকলে আপনার নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট হয় যেমন, তেমনি অন্যদের কাছে আপনি বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠেন। তাই ব্যক্তিগত কর্তাবার্তা মেসেজের ইনবক্সে হওয়াই ভালো। আপনি এমন বিষয় নিয়ে বলুন যা অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, গুরুত্ব পায়। কোনো সামাজিক সমস্যা, এলাকার কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ, নিজের কোনো কাজের স্বীকৃতি, পরিবার বা বন্ধুদের বিশেষ অনুষ্ঠান, কাউকে সাহায্য করার বিষয় কিংবা হতে পারে সরকারের কোনো বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনা। কিছু নামকরা ব্যক্তি যাদের খেলাধুলা, শিল্পসংস্কৃতি, সাহিত্য বা অন্য বিষয় পরিচিতি রয়েছে তাঁরা ঘণ্টা দুই ঘণ্টা পরপর কিছু না কিছু পোস্ট দিয়ে যাচ্ছেন। সেলিব্রিটিদের সব বিষয় অন্যদের কাছে গুরুত্ব নাও পেতে পারে। তা ছাড়া এতে স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের মনে ধারণা জন্মায়, ওনার কি আর কোনো কাজকর্ম নেই, সারাক্ষণ ফেসবুকে বসে থাকেন। এভাবেই আপনি আপনার ব্যক্তিত্ব ও ইমেজ অন্যদের কাছে খাটো করে ফেলেন।
ফেসবুক ব্যবহারকারীদের জন্য লাইক একটি বহুল ব্যবহৃত বিষয়, অনেকই বুঝে না বুঝে লাইক দেন। লাইক মানে পছন্দ, কিন্তু ফেসবুকে লাইক অর্থ হচ্ছে, আপনার পোস্টটা আমি দেখলাম বা সহমত হলাম বা পছন্দ করলাম। এখানে দেখা বা জানা মানেই পোস্টটি কিন্তু পছন্দ করা নয়। কাজেই লাইক দেওয়ার আগে ভেবে নিন আপনি ঠিক কোন অর্থে লাইক দিচ্ছেন। আবার অনেক চেনা, অচেনা, পরিচিত, স্বল্পপরিচিত বা অপরিচিত অনেককেই বন্ধু বানিয়ে ফেলেন শুধু বন্ধু তালিকা বড় করার জন্য। কিন্তু দেখা যায়, অনেক বন্ধুর সঙ্গে তিন মাস, ছয় মাসেও একবার কথা হয় না। কেউ ইনবক্সে কিছু জিজ্ঞেস করলে বা কুশল জানতে চাইলেও অপর পক্ষ কোনো উত্তর দেন না। কিন্তু মনে রাখতে হবে উত্তর না দেওয়াটা অসৌজন্যতা, এক ধরনের অভদ্রতা। ভেবে দেখুন আপনি যে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং বা মহল্লায় থাকেন, মুখ চেনা লোকটি আপনার পাশ দিয়ে যেতে আপনাকে সালাম দিলেন, কুশল জানতে চাইলেন বা চোখে চোখ পড়ায় একটু হেসে দিলেন কিন্তু আপনি কোনো প্রতি উত্তর না করে তাঁকে এড়িয়ে গেলেন। ফেসবুকের ব্যপারটিও অনেকটা সে রকম। অনেকে ভাবেন আমি তাঁর সামনে নেই, আমাকে দেখছে না কিন্তু ফেসবুক ভার্চুয়াল হলেও আপনার চ্যাট লিস্ট বা ওয়াল পোস্টের মাধ্যমে আপনার উপস্থিতি অন্য মানুষটি ঠিকই দেখতে পাচ্ছেন। কাউকে অযথা অবহেলা করা কিংবা উত্তর না দেওয়া ততক্ষণ উচিত হবে না, যতক্ষণ না উনি আপনার কোনো পোস্ট কিংবা মেসেজের মাধ্যমে আপনার সঙ্গে অসদাচরণ করছেন। অনেকে আবার কোনো পোস্ট পছন্দ হলে সেটা এক বা একাধিক বন্ধুদের ওয়ালে শেয়ার দিয়ে থাকেন। মনে রাখবেন কোনো বিষয় আপনার পছন্দ হওয়া মানে আপনার বন্ধুরও পছন্দ হবে এমন কোনো কথা নেই। আবার ওনার ভালো লাগলেও তিনি হয়তো চান না বিষয়টি তাঁর ওয়ালে অন্যরা সেটা দেখুক। কাজেই শেয়ার করার আগে ভালো করে ভেবে নিন।
সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে প্রায়ই দেখা যায় কোনো একটি পোস্টের ওপর তুমুল বিতর্ক হয়। গঠনমূলক আলোচনা ও বিতর্কের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় তর্কের ভাষা জনসম্মুখে প্রকাশের মতো নয়। কেউ কেউ চরম পন্থায় কথা বলেন। নিজের মত ছাড়া অন্যদের মত সহ্য করতে পারেন না। চরম পন্থা কখনো মানুষের জন্য, সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। কাজেই ধৈর্য্শীল ও পরমত সহিষ্ণুতা অত্যন্ত জরুরি, বিশেষ করে আপনি যখন সমাজে আর দশজন মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করেছেন।
ফেসবুক আসক্তি নিয়ে ইদানীং প্রচুর কথা হচ্ছে, লেখালেখি হচ্ছে, অফিসে অনেক কোম্পানি ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছে অথবা ব্যবহারের সময় বেঁধে দিয়েছে। কোনো কোনো দেশে ফেসবুকের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সমস্যা তৈরি হওয়ায় সরকার ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে ফেসবুক ব্যবহারে আপনার একটি সময় বেঁধে নেওয়া উচিত। কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা যেমন অনেক শারীরিক সমস্যা তৈরি করছে, তেমনি এতে মানসিকভাবেও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লক্ষ করুন, আপনি সারা দিন অফিস করে এসেছেন, বাসায় পরিবারের সদস্যদের সময় দিতে হবে, ব্যক্তিগত কিছু কাজ জমে থাকে। এসব বাদ দিয়ে আপনি ফেসবুক নিয়ে বসে গেলেন। আপনার ওয়ালে দেখা গেল অনেক নোটিফিকেশন, সবগুলো দেখতে হলে অনেক সময় লাগে। এর মাঝে নানা রকম বিজ্ঞাপনের পোস্ট আসতে থাকে। বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকার নিউজ ফিড আসে। বন্ধুর ট্যাগের কারণে অনেক অপরিচিতি মানুষের পোস্ট আপনাকে দেখতে হয়। বহু ধরনের বিচিত্র সব বিষয় ক্রমাগত আপনার সামনে উপস্থিত হয়। মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা অসীম হলেও কত বিষয়, কতটুকু তথ্য মস্তিষ্ক নেবে, চিন্তা করবে, বিশ্লেষণ করবে আর প্রতিক্রিয়া জানাবে এটা নির্ভর করে আপনার ওপর অন্যান্য বিষয়ে চাপ অর্থাৎ পেশাগত, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজকর্মের চাপ ও পরিস্থিতির ওপর পড়ে। কাজেই ফেসবুকে কতটা সময় কাটাবেন, কতটুকু প্রতিক্রিয়া জানাবেন, সেটি আপনার মর্জি বুঝে ঠিক করে নিন। চেষ্টা করুন বিচিত্র তথ্য-উপাত্ত যেন আপনার মনে বাড়তি চাপ সৃষ্টি না করে। আপনার মানসিক সুস্থতা আপনার নিজের ও প্রিয়জনদের জন্য অবশ্যই অগ্রাধিকারের বিষয়। ফেসবুক অতিরিক্ত ব্যবহারের আসক্তির থেকে মুক্তির উপার খোঁজা হচ্ছে নানাভাবে। এমনকি সম্প্রতি খোদ ফেসবুকের প্রধান মার্ক জাকারবার্গ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বছরের একটি দিন ফেসবুক বন্ধ রাখবেন। আর তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফেসবুক ব্যবহাকারীদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে।
ফেসবুকে আমিত্ব বা শুধু নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রকাশ করার প্রবণতা দেখা যায়। এই আমিকেন্দ্রিক চিন্তা অনেককে অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। আপনি যা নন, তার চেয়ে নিজেকে ওপরে তুলে নিজেকে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করে বাহবা পাওয়ার চেষ্টায় মগ্ন থাকেন। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে ফেসবুকে প্রকাশ করা চরিত্রের মাঝে যখন অমিল দেখা যায়, তখন হতাশা আর হীনমন্যতা তৈরি হয় তখন মানুষের মধ্যে ব্যক্তিত্বের জটিলতা দেখা দেয়। তাই ফেসবুকে বাস্তবে যেমন ঠিক তেমনিভাবে নিজেকে তুলে ধরা উচিত।
নিবন্ধটি পড়ে কেউ আবার যেন ভাববেন না যে ফেসবুক ব্যবহার করতে হলে এত সব নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে। ফেসবুক মানুষের স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশের একটি অনন্য মাধ্যম। প্রযুক্তির অপব্যবহার অনেক রকম অপকার ও ক্ষতিসাধন করে বলেই ফেসবুকের যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে এখানে কিছু ধারণা দেওয়া হয়েছে। কাজেই ফেসবুক ব্যবহারে আপনি কতটা উপকৃত হবেন বা অপকৃত হবেন সেটা অনেকখানি নির্ভর করে আপনার ব্যবহার কৌশলের ওপর। ফেসবুকের মতো এত সহজ-স্বাচ্ছন্দ্য ও নিজের মতো করে ব্যবহারের সুযোগ আর কোনো সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে নেই বলেই ফেসবুক এতটা জনপ্রিয়। বিনোদন পাওয়া, তথ্য সংগ্রহ করা, দূরের বা কাছের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, যেটার জন্যই ফেসবুক ব্যবহার করেন না কেন মনে রাখবেন ফেসবুক আপনার ব্যক্তিত্ব, রুচিবোধ ও মানসিকতা অন্যদের কাছে তুলে ধরে। কাজেই ফেসবুকে আপনার ফেস কেমন হবে, আকর্ষণীয় না কুৎসিত? ফেসবুকে ফেস বা মুখ রক্ষা করার দায়িত্ব কিন্তু আপনাদের ওপরই!
লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, মাইক্রোসফট মালয়েশিয়া
Email: [email protected]