যে ৮ কারণে বেসিক ফোনই সেরা
মোবাইলে ফোন জনপ্রিয় হওয়ার শুরুর দিককার কথা মনে আছে? সাদাকালো মনিটর আর শক্ত বাটন চেপে ফোনে কথা বলতে পারাটাই ছিল মোবাইল ফোনের একমাত্র এবং সবচেয়ে বড় ব্যবহার।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে হাতের মুঠোয় থাকা যন্ত্রটির ভিতর আসা শুরু করে বিভিন্ন ফিচার। কালার স্ক্রিন, গান ও রেডিও শোনা কিংবা কোনো রকমের একটি ক্যামেরাই ছিল অবাক করার মতো ব্যাপার। স্লাইডিং কিংবা ফোল্ডিং হ্যান্ডসেট আর টাচস্ক্রিন ছিল ফ্যাশনেবল ফোন।
হিসেব বদলানো শুরু করে গত দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে, যেটি চলতি দশকে এসে ধারণ করেছে চরম রূপ। ২০০৭ সালে প্রথমে আইফোনের আবির্ভাব এবং ২০০৮ সালে গুগলের অ্যানড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম পরিবর্তন করে দেয় হ্যান্ডসেটের ধারণাকে।
ছোট হ্যান্ডসেটটি আর ছোট নেই। বড় স্ক্রিনের ‘স্মার্টফোন’ প্রথমে বিলাসিতা আর ফ্যাশনের নাম হলেও বর্তমান যুগে এটি পরিণত হয়েছে মানুষের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশে।
মানুষের মধ্যে স্মার্টফোনের চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তা এতই বেশি, যে চার-পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়েও এখন মোটামুটি মানের স্মার্টফোন বিক্রি করছে হ্যান্ডসেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
তবে অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার হচ্ছে এখনো কিছু মানুষ ব্যবহার করে চলেছেন পুরোনো দিনের সেই বেসিক হ্যান্ডসেটগুলো। কিন্তু কেন? ভারতীয় সংবাদ চ্যানেল এনডিটিভির একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে কেন এখনো এসব বেসিক ফোন ব্যবহারকারীদের কাছে জনপ্রিয়।
১. সাইজ
ভিডিও দেখার জন্য কিংবা আরামে ইন্টারনেট চালানোর জন্য বড় স্ক্রিনের স্মার্টফোন সবারই পছন্দ। কিন্তু মুঠোফোনের ধারণাকে অনেকটাই বদলে দিয়েছে এই হ্যান্ডসেটগুলোর সাইজ। ৫-৬ ইঞ্চির বিশাল স্মার্টফোন পকেটে ভরে চলাফেরা করা একটা বিশাল সমস্যাই বটে।
এ ছাড়া হাতে নিয়ে ব্যবহার করাটাও বেশ কষ্টকর। বিশাল হ্যান্ডসেট হাতে নিয়ে ব্যবহার করার কারণে হাতের ব্যথায় ভোগার কথা অনেক ব্যবহারকারীই স্বীকার করেছেন। অন্যদিকে বেসিক হ্যান্ডসেটগুলো আকারে ছোটখাটো, তাই সেগুলো পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যেমন সহজ, তেমনি হাতে রেখে ব্যবহার করাও বেশ আরামদায়ক।
২. মজবুত
স্মার্টফোন ব্যবহার করার বিশাল একটি ঝুঁকি হচ্ছে, যেকোনো সময় এটি হাত থেকে পড়ে গেলে স্ক্রিন ভেঙে যেতে পারে কিংবা সেট অকেজো হয়ে যেতে পারে। চোখের সামনে সাধের স্মার্টফোনের ডিসপ্লে ফেটে যাওয়ার মতো বেদনাদায়ক ঘটনার অভিজ্ঞতা আছে অসংখ্য মানুষের।
কিন্তু এদিক থেকে অনেকটাই নিশ্চিন্তে ব্যবহার করা যায় ‘নোকিয়া ১১০০’-এর মতো বেসিক হ্যান্ডসেটগুলো। হাত থেকে পড়ে ভাঙা তো দূরে থাক, তেমন একটা ক্ষতিও হয় না সেগুলোর। এ নিয়ে প্রযুক্তি দুনিয়ায় প্রচলিত কথা হচ্ছে, নোকিয়া ১১০০ হাত থেকে পড়লে আপনার মেঝের ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু সেট থাকবে অক্ষত!
৩. দাম
কখনো চিন্তা করেছেন একটি স্মার্টফোন কিনতে কত টাকা খরচ করছেন? যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ফ্ল্যাগশিপের মালিক হতে হলে ৬০-৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে একটি হ্যান্ডসেটের পেছনে। মোবাইল কেনার জন্য এই টাকা জোগাড় করা কিন্তু কম কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। আইফোন কেনার জন্য নিজের কিডনি বিক্রি করে দেওয়ার মতো দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছে। অথচ মাত্র এক থেকে দুই হাজার টাকা খরচ করে কিন্তু আপনি একটি বেসিক হ্যান্ডসেট কিনতে পারছেন। মোবাইল ফোনের মূল যে কাজ কল করা এবং ধরা সে সুবিধা তো পুরোদমে পাবেন। সাথে টেক্সট পাঠানো, ক্যালকুলেটর, ঘড়ি, কনভার্টার কিংবা রেডিও শোনার মতো কাজও বেসিক হ্যান্ডসেটগুলো দিয়ে অনায়াসেই করা যাবে।
৪. ব্যাটারি লাইফ
স্মার্টফোনে পুরো একদিন চার্জ থাকাটা বিশাল ভাগ্যের বিষয়। বেশিক্ষণ চার্জ না থাকায় মোবাইলের সাথে চার্জার কিংবা পাওয়ার ব্যাংক নিয়েও ঘুরে বেড়াতে হয় সবসময়। সাধারণত একদিনে দুইবার করে হ্যান্ডসেট চার্জ দিতে হয় স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা। অন্যদিকে বেসিক হ্যান্ডসেটগুলোর কম পাওয়ার প্রসেসরের কারণে এত বেশি চার্জ দিতে হয় না। ৩০০ এমএইএইচের ব্যাটারি সমৃদ্ধ বেসিক মোবাইল ফোনও একবার চার্জ দিলে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় চলবে। চার্জ নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে হলে বেসিক ফোনই ভরসা।
৫. ডিজাইন
টাকা বেশি ঢাললেই যে সুন্দর ফোন হাতে পাওয়া যাবে, সেই ধারণাটি একেবারেই ভুল। স্মার্টফোনের বড় টাচস্ক্রিনগুলো মোটামুটি ৭০ শতাংশ জায়গা দখল করে রাখে। রূপসজ্জার জন্য তাই ডিজাইনাররা বেছে নেয় ব্যাক কাভার! অথচ মনে আছে মটোরলার রেজার সিরিজের ফ্যাশনেবল সেটগুলোর কথা? কিংবা বিখ্যাত সেই নোকিয়া ৩৩১০? নোকিয়ার এন সিরিজের চোখধাঁধানো একটি হ্যান্ডসেট হাতে থাকাটা ছিল আভিজাত্যের পরিচয়। এ ছাড়া তখনকার বাজার কাঁপানো ফ্লিপ ফোন আর স্লাইডিং হ্যান্ডসেটগুলোর আবেদন কিন্তু এখনো ফিকে হয়নি। এলজি এবং স্যামসাংয়ের মতো সফল অ্যানড্রয়েড হ্যান্ডসেট নির্মাতারাও নতুন করে ফ্লিপ ফোন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
৬. নিরাপত্তা
বলা যেতে পারে এটি স্মার্টফোনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। স্মার্টফোনের কারণে মানুষের জীবন থেকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যাপারটা দিনে দিনে প্রায় উঠেই যাচ্ছে। একটি স্মার্টফোন ভর্তি থাকে ব্যক্তিগত জিনিস দিয়ে। চিন্তা করুন, আপনার স্মার্টফোনটি যদি কোনোদিন হারিয়ে যায়, তার সাথে আপনার ব্যক্তিগত ইমেইল, ছবি, আপনার লেনদেনের তথ্য, ক্রেডিট কিংবা ডেবিট কার্ডের তথ্যসহ অনেক কিছু অন্যের হাতে চলে যাবে। এমনকি ম্যালওয়্যার আক্রমণের মাধ্যমে হ্যাকাররাও আপনার সবকিছু হস্তগত করে ফেলতে পারবে, যা আপনি বুঝতেও পারবেন না। এ ছাড়া স্মার্টফোনে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমেও প্রায়ই আপনার ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হতে পারে। অথচ চিন্তা করুন আগের দিনের সহজ-সরল হ্যান্ডসেটগুলোর কথা। সেসব মোবাইল ফোন হারিয়ে গেলে কিংবা চুরি হলে কিছু কন্টাক্ট নম্বর ছাড়া চোর আর কিছুই খুঁজে পাবে না।
এসব কথা বাদ দিন। ৫০ হাজার টাকা দামের কোনো হ্যান্ডসেট চুরি বা ছিনতাই হয়ে গেলে সেই কষ্ট কি এত সহজে ভোলা যাবে? অথচ আপনার এক-দেড় হাজার টাকা দামের বেসিক ফোনটি ভাঙলে, নষ্ট হলে, চুরি কিংবা ছিনতাই হলেও চটপট আরেকটা কিনে নিতে পারবেন।
৭. ভার্চুয়াল জগত থেকে মুক্তি
স্মার্টফোন প্রেমীদের প্রায় সারাদিনই দেখা যায় ফোন হাতে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ব্যস্ত। ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করতে করতে মানুষ বাস্তব জীবনের সমাজ থেকে প্রায় বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। তাই স্মার্টফোনটি ফেলে হাতে নিন বেসিক ফোন। পরিবারের সাথে সময় কাটান, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিন কিংবা বাস্তব জীবনে মনোযোগ দিন।
উপলব্ধি করুন প্রিয়জনের সাথে কাটানো সময়কে উপভোগ্য করে তুলতে চেক-ইনের সাথে ১০টি সেলফি আপলোড করে দুনিয়াকে জানানোর কোন প্রয়োজন নেই। বরং নিজেদের মতো উপভোগ করুন সময়গুলো।
৮. সময় বাঁচান
স্মার্টফোনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হচ্ছে এর বহুমুখিতা। হাতের মুঠোয় এক ফোন দিয়েই দুনিয়ার সব কাজ করে ফেলা যায়, কিন্তু সত্য হচ্ছে তার বেশিরভাগই তেমন একটা উপকার বয়ে আনতে পারে না। দিনের একটি লম্বা সময় মুঠোফোনে ব্যয় করার ফলে অন্যান্য কাজের জন্য মানুষের হাতে আর সময় থাকছে না। অথচ বেসিক ফোন দিয়ে আপনার যোগাযোগের কাজটা হয়ে যাবে আর বাকি কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত সময়ও পাবেন।
কম্পিউটার কিংবা ট্যাব যাদের রয়েছে তাদের আসলে স্মার্টফোন না থাকলেও চলে। কারণ স্মার্টফোনে যে কাজগুলো আপনি করে থাকেন, তার সবই আপনি ওই দুটি ডিভাইসে করতে পারবেন। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে কম্পিউটারের সামনে বসে প্রয়োজনীয় ইমেইল চালাচালি করে নিতে পারলেন, তাতে আপনার সময় সাশ্রয় হবে। কিন্তু স্মার্টফোন সাথে থাকলে শুধু মেইল চালাচালি নয়, ফেসবুক, টুইটার নানা বিষয়ে সময় চলে যায় হুঁ হুঁ করে।
তাই সাধারণ ফোনকেই এখন পুনরায় পছন্দ করতে শুরু করেছেন অনেকে।
কোথায় পাবেন
যদি আসলেই সাধারণ মানের হ্যান্ডসেট কিনতে চান, তাহলে বসুন্ধরা সিটি, ইস্টার্ন প্লাজা, ইস্টার্ন প্লাস কিংবা স্টেডিয়াম মার্কেটের মোবাইল ফোনের দোকানগুলোতে দেখতে পারেন। সস্তায় এখনো অনেক সাধারণ মানের হ্যান্ডসেট বিক্রি হয়।
মাইক্রোসফট কিংবা স্যামসাংয়ের শো-রুমগুলোতে এখনো বেসিক হ্যান্ডসেটগুলো এক থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। এমনকি অনেক অনলাইন শপও বর্তমানে পুরোনো দিনের বিখ্যাত সব হ্যান্ডসেট বিক্রি করছে।