পরমাণু শক্তি কি নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব?
এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যেও। কিন্তু পরমাণু বর্জ্যের তেজস্ক্রিয়তা থেকে মানুষকে নিরাপদে রাখতে যে উপযুক্ত সংরক্ষণাগার প্রয়োজন, এ বিষয়ে একমত প্রায় সবাই।
এ ব্যাপারে এগিয়ে গেছে ফ্রান্স। পাথুরে জমির নীচে গভীরে সুরঙ্গ করে চলছে পরীক্ষা। একটি পরীক্ষার অংশ হিসাবে এই খননকাজ ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। নির্মাতা, গবেষক এবং বিজ্ঞানীরা প্রতিদিনই ফরাসি অঞ্চল লোরেন এর পাশের গ্রামের ব্যুর-এ আসেন। তারা জানতে চান অন্তত পরবর্তী একশো হাজার বছর ধরে এই পাথর অটুট থাকবে কিনা।
এমিলিয়া উ্যরে একজন ভূতাত্ত্বিক এবং এই কর্মকাণ্ডের প্রধান। তিনি ৫০০ মিটার নীচে তার ভূগর্ভস্থ শিলা পরীক্ষাগার ঘুরে দেখান ডয়চে ভেলেকে। এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ৮৫ হাজার ঘনমিটারেরও বেশি তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের ভাণ্ডার তৈরি করা হবে। গবেষণাগারটি এরই মধ্যে বিশাল আকার নিয়েছে। সুরঙ্গটি দুই কিলোমিটারেরও বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। শিলা কীভাবে নড়াচড়া করছে, সেই বিষয়গুলো সেন্সরের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
এমিলিয়া উ্যরে বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন পদার্থ কীভাবে আচরণ বদলায় সেটা খুঁজে বের করতে চাই আমরা। আমরা এই বোরহোলে অবক্ষয়ের প্রভাব অনুকরণ করছি। তেরো বছর আগে আমরা একটি কাঁচের ম্যাট্রিক্সকে পাথরে মধ্যে নামিয়েছিলাম, তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের পাত্রে ব্যবহৃত উপকরণগুলির মধ্যে এটি একটি।’
সবচেয়ে বিপজ্জনক উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় বর্জ্য এই ধরনের ইস্পাতের কন্টেইনারে পুরে ক্ষুদ্র সুরঙ্গের মধ্য দিয়ে পাথরের আরও গভীরে নিয়ে যাওয়া হবে। এ কাজে ব্যবহার করা হবে রোবট। ফ্রান্সের সমস্ত উচ্চ তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ধরে রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছে এই ভান্ডার।
উ্যরে বলেন, ‘আপনি যেমনটা দেখতে পাচ্ছেন, আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী দারুণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে এই কাদামাটির পাথরটিতে। এটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, এর পৃষ্ঠ একই রকমের এবং খুব কম ছিদ্রযুক্ত। ফলে এটি কোনো তরল ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় না। এই শিলাটি কার্যত অভেদ্য।’
কিন্তু এমিলিয়া উ্যরে এর গ্র্যান্ড প্রজেক্ট এখনও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। এখনও এই শিলায় তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সংরক্ষণের সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষা করছেন তিনি। তবে পাঁচ বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। ২০৫০ সালে প্রথম কন্টেইনারগুলো এই সংরক্ষণাগারে যাওয়ার কথা রয়েছে। মাটির ওপরের অংশে এই সংরক্ষাণাগার তেমন একটা দর্শনীয় নয়। প্যারিস থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পূর্বে একটি জনবিরল এলাকায় এটি অবস্থিত।
এখানে পরিস্থিতি বেশ শান্তিপূর্ণ। রাস্তায় মানুষজনও খুব কম। কিন্তু এই শান্ত গ্রামেও পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে উঠছে। এই সংরক্ষণাগার সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন অ্যাক্টিভিস্টরা। পারমাণবিক শক্তির বিরোধিতা করছেন অনেকে। এই ভবনটি এখন প্রতিরোধের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। সমগ্র ইউরোপ থেকে অ্যাক্টিভিস্টরা এখানে আসেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি শান্ত।
এমিলিয়া জানেন, জার্মানরা পরমাণু শক্তিতে অন্যভাবে দেখেন। তিনি বলেন, ‘জার্মানি জ্বালানি নীতির বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পর্যায়ে আমরা এখনও একসঙ্গে কাজ করছি। জার্মানিও একটি উপযুক্ত পারমাণবিক বর্জ্য সংরক্ষণাগার খুঁজছে।’
তেজস্ক্রিয় বর্জ্য হঠাৎ নাই হয়ে যাবে না, ফলে এর স্থায়ী সংরক্ষণাগার এখন খুঁজে পাওয়াই জরুরি। উ্যরে মনে করেন, এটি দায়িত্বশীলতারও প্রশ্ন। তিনি বলেন, ‘আমরা পারমাণবিক বর্জ্যের সংকটটি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য রেখে দিতে চাই না। ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা এবং ভূগর্ভস্থ পাথরে অনুসন্ধানের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, পরিকল্পিত সংরক্ষণাগারই হলো সবচেয়ে নিরাপদ এবং টেকসই সমাধান।’
পর্যাপ্ত বিকল্পের অভাবে সরকার সম্ভবত প্রকল্পটিকে অনুমোদন দিতে পারে। এই ক্ষেত্রে ফ্রান্স জার্মানির চেয়ে অনেক এগিয়ে। জার্মানিতে স্থায়ী সংরক্ষণাগারের সন্ধানে আরও কয়েক দশক সময় লাগবে।