আলতাদীঘির আভিজাত্য
কথিত আছে, এই এলাকায় শতাব্দীকাল আগে এক জমিদার বাস করতেন। এক বছর গরমের সময় প্রচণ্ড খরা দেখা দেয়। এলাকার প্রজারা পানির কষ্টে কাতর হয়ে জমিদারের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে, যেন পানির কষ্ট কিছুটা হলেও দূর হয়। সেই রাজার রানি খুব দয়ালু ছিলেন, তিনি প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করতে এক অভিনব পন্থা বেছে নিলেন। পরদিন সকালে রানি তাঁর পাইক-পেয়াদা নিয়ে বাইরে বের হলেন। বের হয়ে রাজবাড়ির অদূরে ঘন অরণ্যের দিকে হেঁটে গেলেন।
এরপর সেই অরণ্যের কাছে গিয়ে ঘোষণা করলেন, তিনি এই অরণ্যের মাঝে হেঁটে যাবেন। হেঁটে যেতে যেতে যখন তাঁর পা ফেটে রক্ত বের হবে, সেখানে তাঁর হাঁটা শেষ করবেন। তারপর হাঁটার শুরু থেকে পা ফেটে রক্ত বের হওয়ার পুরো জায়গাজুড়ে পুকুর খনন করতে হবে, যে পুকুরের জলে প্রজাদের পানির কষ্ট দূর হয়ে যাবে। পাইক-পেয়াদা রানির কথায় সম্মত হলে রানি হাঁটা শুরু করলেন। কিন্তু হাঁটা শুরু হওয়ার পর, অনেকটা হেঁটে যাওয়ার পর পাইক-পেয়াদারা পরামর্শ করল, রানির যদি সহজে পা ফেটে রক্ত না বের হয়, তাহলে বিশাল পুকুর খনন করতে হবে। তাই তাঁরা পেছন থেকে রানির পায়ে আলতা ঢেলে দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে বলে রানিকে থামতে বাধ্য করে। আর তারপর সেই জায়গায় বিশাল একটা দীঘি খনন করা হয়। যার নাম দেওয়া হয় আলতাদীঘি। এই গল্প শুনে লোভে পড়ে ছুটে গিয়েছিলাম সেই আলতাদীঘি দেখতে।
নওগাঁ জেলার ধামুরহাটে পথচলা শুরু করতেই পথের দুপাশের সবুজ ধানক্ষেতের আমন্ত্রণে মুগ্ধ হওয়া। দুপাশের যত দূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজ প্রান্তরের সঙ্গে মিলেমিশে আছে ঝকঝকে নীল আকাশের আকর্ষণ, নীল আকাশের কোথাও কোথাও সাদা মেঘের আপন মনে উড়ে চলা, পথ চলতে রাস্তার দুপাশে গাছ আর ঘাসের ছুঁয়ে যাওয়া আর মাঝেমধ্যে ভাঙা পথের ঝাঁকুনি খেতে খেতে ভীষণ অবাক করে দিয়ে চোখে পড়ল ঘন অরণ্যে আবৃত বড় বড় গাছের সমারোহ, একের পর এক বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে আচ্ছাদিত এক অভয়ারণ্য যেন। বিস্মিত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম, যেন অজানা কোনো গহিন বনের মধ্যে ঢুকে পড়েছি ভুল করে।
এমন নিখাদ অরণ্যের মাঝে যেতে যেতেই কিছুদূর পর চোখে পড়ল আলতাদীঘি অভয়ারণ্যের সরকারি সাইনবোর্ড। তার মানে প্রতীক্ষিত আলতাদীঘিতে প্রবেশ করেছি। ভাবতেই দারুণ আনন্দবোধ হতে লাগল আর কিছু অস্থিরতা। অনেক অপেক্ষার কিছু যখন সামনে এসে যাই যাই করে, আমার সব সময়ই কেমন যেন একটা অস্থির অনুভূতি হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।
অরণ্যের মাঝ দিয়ে চলেছি আলতাদীঘির পথে। দুই থেকে তিন মিনিট হেঁটে সামনে এগিয়ে, একটি বাঁক নিয়ে অন্য বাঁকে পৌঁছাতেই কেমন যেন লোকে-লোকারণ্য দেখে কৌতূহল তৈরি হলো, পৌঁছে গেছি নাকি? আমার বাঁয়ে গভীর অরণ্য আর ডানে গাছগাছালি, আর ক্ষেতের মাঝের আইলের ওপারে বাঁশগাছের ফাঁকফোকর দিয়ে টলটলে জলে শেষ দুপুরের সূর্যের আলোর ঝলকানি এসে লাগল চোখে। কী ওখানে? একটু ভালো করে তাকাতেই দেখি টলটলে জলের মাঝে বড় বড় সবুজ পাতার আচ্ছাদন, যার মাঝে হেলেদুলে দাঁড়িয়ে আছে সাদা-গোলাপি পদ্মের দল। আহা, তার মানে এসে পড়েছি, সেই লুকানো আভিজাত্যের কাছে, অপেক্ষার আলতাদীঘির পাড়ে।
ঝটপট রাস্তা ছেড়ে বনের মধ্য দিয়ে, ক্ষেতের আইল ধরে আলতাদীঘির পাড়ে চলে এলাম। সচরাচর আমার মুখ দিয়ে যে শব্দ বের হয় না, সেটাই বেরিয়ে এলো তাকে প্রথম দর্শনে—ওয়াও, এ কী দেখছি! এত বিশাল, এত বিশাল আর এত বিশাল যে দীঘির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঠিকমতো দেখাই যায় না। দেখা যাবে কী করে, এক কিলোমিটারের চেয়েও দীর্ঘ এই দীঘির বিস্তার।
ভাগ্যিস, দীঘির আর একটু কাছে গিয়েছিলাম বলে, নইলে এমন অপার্থিব রূপের দর্শন কী পেতাম? মোটেই না। কাছে গিয়ে বসতেই দেখি বড় বড় পদ্ম পাতার ওপর বড় সাইজের মুক্তাদানার মতো টলটল করছে জলের ফোঁটা। হাঁসের জলকেলির সময় কিছু কিছু জলের ফোঁটা সবুজ পদ্ম পাতার ওপরে উঠে গেছে, যা সূর্যের আলোর ঝিলিকে ঝলমল করছে। একটি-দুটি পাতায় নয়, শত শত পদ্মপাতার ওপর এমন জলের ঝিলিক পুরো দীঘিকেই কেন এক মুক্তার আঁধার বানিয়ে ফেলেছে! আর সেই পদ্মপাতা, জলের মতো মুক্তার ঝিলকের মাঝেমধ্যে স্বমহিমায় নিজের আভিজাত্যের জানান দিচ্ছিল সাদা, গোলাপি পদ্মফুলেরা।
দীঘির অন্য পাড়ে চলে গেলাম বন্ধুর বাড়ির সীমানা ধরে। যে পাড়ের মুগ্ধতা আরো অনেক অনেক বেশি। পদ্মগুলো যেন এপারেই বেশি আকর্ষণীয়, বেশি মাধুর্য ছড়ানো আর অনেক বেশি আভিজাত্যের সম্মোহনী সৌন্দর্য নিয়ে জলে ভেসে আছে। একদম দীঘির পাড়ঘেঁষে পদ্মফুলের শুরু, যা বিস্তৃত যতদূর দেখা যায়। এপারে আছে শালগাছের অরণ্য, পাড়জুড়ে ছায়াঘেরা পথ, বসার জন্য গাছের গুঁড়ি, আর ইট-পাথরের বেদিও। আছে ঘাটে বাঁধা ছোট ডিঙিনৌকা। নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে ঘুরে আসা যায় টলটলে দীঘির ঢেউহীন জলে, ছুঁয়ে দেখা যায় শিহরিত হওয়া যায় সাদা-গোলাপি পদ্মের কোমল শরীর। হাত দিয়ে সরিয়ে দেওয়া যায় পদ্মপাতায় জমে থাকা মুক্তাদানার মতো জলের বিন্দু। সত্যিই আলতাদীঘি বাংলাদেশের এক লুকানো আভিজাত্য।