কাজলী নদীর তীরে
যেকোনো ভ্রমণে সকালটা যদি সুন্দর, মন ভালো করা আর নতুন কিছু দেখে উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো না হয়, সেদিনের সে ভ্রমণ আর মনের মতো হয়ে ওঠে না। আগের দিন মেহেরপুর পৌঁছেছিলাম প্রায় সন্ধ্যা নামার মুখে। এক সহকর্মীর বাড়ি সেখানে হওয়ায় দারুণ ব্যালকনিসহ একটা হোটেল রুম পেয়ে গিয়েছিলাম শুরুতেই। পরে সেই সহকর্মীর আতিথ্যে রাতে ভরপুর খাবার আর মেহেরপুরের মিষ্টি খেয়ে মনপ্রাণ মিঠে করে রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম। সহকর্মী পরামর্শ দিয়েছিলেন, আগে মুজিবনগরে না গিয়ে আমঝুপি নীলকুঠি ঘুরে আসতে। যেটা আমাদের গন্ত্যব্যের উল্টো পথে পাঁচ কিলোমিটার। তার মানে দিনের শুরুতেই ১০ কিলোমিটার বেশি চালাতে হবে।
এ ভাবনা যখন মাথায় এলো, তখন চিন্তা করলাম কী আছে আমঝুপি নীলকুঠিতে? এই ১০ কিলো অতিরিক্ত যাওয়া-আসা শেষ পর্যন্ত পোষাবে তো। তবুও সহকর্মী যেহেতু বলেছে, তাই যাওয়া মনস্থির করলাম। এ জন্য যে সে আমার পছন্দ কিছুটা হলেও জানে। তাই বাইক সেদিকে ঘুরিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমঝুপি নীলকুঠির দিকে। গিয়েই দেখি কেমন লাগে! যেতে যেতে মনে মনে ভাবছিলাম, সহকর্মী যেহেতু পরামর্শ দিয়েছে, কিছু না কিছু আছে। সকাল সকাল পথে গাড়ির চাপ না থাকায় বেশ দ্রুত হাইওয়ে ধরে পৌঁছে গেলাম আমঝুপির নির্দেশনা সমন্বিত রাস্তার মোড়ে। বাঁক নিয়ে অল্প কিছুটা যেতেই আমঝুপির নীলকুঠির কাঠের ডালের গেট। কিছুটা মেকি হলেও একদম মন্দ নয়।
তবে সেই গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ল অদূরে একদম জীর্ণ, প্রায় ক্ষয়ে যাওয়া দুটো স্থাপনা, যা বহু পুরোনো বাড়ির ইতিহাস বহন করে চলেছে। ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে যেতেই সেই স্থাপনা দুটোর পেছনে একটা রুপালি ফিতার মতো আঁকাবাঁকা কিছু জ্বলজ্বল করছে মনে হলো। যা আমাকে মুহূর্তেই মুগ্ধ করেছে, আমার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল। তাই তো বাইক থেকে নেমে সোজা সেই রুপালি জ্বলজ্বলে ফিতার আকর্ষণে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। একটু এগোতেই আমি থমকে গেলাম।
না চাইতেও প্রেয়সীকে আচমকা সামনে পেয়ে গেলে মানুষ যেমন হতভম্ব হয়ে যায়, আমারও ঠিক তেমন হয়েছিল। কারণ সামনে যেতেই দেখি, রুপালি ফিতার মতো সেই ধারাটা আসলে এঁকেবেঁকে চলা নদী। আর নদীর দেখা পাওয়া মানে সারা দিনের জন্য আমার একা একা আনন্দে ভেসে যাওয়া। নদী আমার এতটাই ভালোবাসার, ভালোলাগার আর আবেগ ছুঁয়ে যাওয়ার। নদী আমার এক অন্য গোপন প্রেমের নাম।
কারণ, যেকোনো ভ্রমণে চলার পথে নদীর দেখা পাওয়া আমার কাছে অনেক বেশি আনন্দের, উপভোগের আর কিছুটা সময় সেই নদীর তীরে বসে ঝিরঝিরে বাতাসে সুখের বিশ্রামের। ভ্রমণে নদী আমার কাছে কৈশোরে স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসার পথে দেখা পাওয়া প্রিয় ও কাঙ্ক্ষিত কোনো মুখের মতো। যার চাহনি, এক টুকরো হাসি, ক্ষীণ দৃষ্টিবিনিময়, আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি দেওয়া সেই দিনটাকে বিশেষ করে তুলত, বর্ণিল হয়ে যেত, আনন্দ আর উচ্ছ্বাস হয়ে চোখেমুখে লেপটে থাকত। রুপালি সেই নদীর দেখা পেয়ে আমার হুবহু একই রকম অনুভূতি হয়েছিল।
আর দেরি না করে, দূরে না থেকে, অপেক্ষা না করে এক ছুটে আমি সেই প্রিয় প্রেয়সীর মতো খুব প্রিয় নদীটির কাছে চলে গেলাম। আহা, কী তার রূপ, রূপের ঝলক, শ্রাবণের ভরা যৌবন নিয়ে সে যে আমারই অপেক্ষায় প্রহর গুনছিল। সে যেন শ্রাবণে ঘন কালো মেঘের অভিমান নিয়ে অপেক্ষা করছিল কখন আমি আসব, তার পাশে বসব, তাকে ছুঁয়ে দেব আর সেই ছোঁয়াতেই তার অভিমান ভেঙে পড়বে শ্রাবণের ধারা হয়ে। যে শ্রাবণধারায় ভিজে ভিজে সুখের অবগাহনে বিলীন হব আমি তাতে, আর সে আমাতে। অসহ্য সুখের অবগাহনে অপার্থিব আনন্দে ভেসে যাব সে নদীর জলে।
নাম-না-জানা সেই প্রেয়সীর নাম জানতে তখন অধীর অপেক্ষা করছিলাম। ঝাঁকে ঝাঁকে রাজহাঁস দলবেঁধে নদীতে আর তীরে খেলা করছিল নিজেদের সঙ্গে। ধীরলয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা নদীটির দুপাশে ঘন সবুজের স্নিগ্ধ পটভূমি। জিজ্ঞাসা করে জানলাম প্রেয়সী নাম কাজলী। এটা কাজলী নদী। ইশ, কী সুন্দর রোমান্টিক আর মায়াবী নাম কাজলী। আগে দূর থেকে দেখে তাকে ভালো লেগেছিল, তারপর কাছে গিয়ে, পাশে বসে তাকে ভালোবেসে ফেলেছি আর তার এমন মায়াবী নাম জেনে তার প্রেমে পড়ে গেছি। আমঝুপি নীলকুঠি বাদ দিয়ে আমি তখন কাজলীকে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। ঠায় বসেছিলাম তার পাশে, তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে, সুখে ভেসে ভেসে।
বসে থাকতে থাকতে, তার নীরব, স্নিগ্ধ, শ্রাবণধারায় সিক্ত রূপের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম ইশ, এখানে যদি একটা কাঠের কুটির বানিয়ে থেকে যাওয়া যেত। এখানে যদি একটা ডিঙি নৌকায় ভেসে যাওয়া যেত। এখানে যদি নিজের একান্ত অলস অবসর কাটানো যেত। এ স্বপ্নে বিভোর হতে হতেই কালো মেঘে ঘন হয়ে থাকা শ্রাবণের আকাশ থেকে সুখের শ্রাবণের সুখের ধারা ঝরতে শুরু করেছিল। না, আমি উঠে যাইনি, আমি ছাতা খুলিনি, আমি রেইনকোটে নিজেকে মুড়ে নিইনি। আমি শ্রাবণের ধারার সঙ্গে, প্রিয় কাজলী নদীর বয়ে চলার সঙ্গে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি, ভিজেছি, সিক্ত হয়েছি, সুখের অবগাহনে তৃপ্ত হয়েছি।