নজরুলের আটচালার আটকাহন
যাত্রাপথে রাস্তার দুধারের সারি সারি বৃক্ষ যেন ঐতিহাসিক যশোর রোডের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এখানে অতিথিদের স্বাগত জানাতে প্রকৃতির আয়োজনের কমতি নেই। চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা। এখানে মিশনপাড়ায় অবস্থিত মাটি ও ছনের তৈরি আটচালা ঘর। খুব সাধারণ মনে হলেও একে ঘিরে জড়িয়ে আছে অনেক গল্প। কবি নজরুল ইসলামের অনবদ্য কিছু সৃষ্টির সাক্ষী বহন করে চলছে বাড়িটি।
সীমান্তবর্তী এলাকা কার্পাসডাঙ্গা। এখানে মূল রাস্তার একেবারে ধার ঘেঁষেই বাড়িটি। প্রাচীরঘেরা বাড়িটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটি ফলক। সেখানে অল্প পরিসরে লেখা আছে বাড়িটির ইতিহাস। ভেতরে হলদে সেই আটচালা ঘর। দেখলে মনে হয়, ঘরটি সূর্যের আলোর রং পুরোটাই ধারণ করেছে। এ ঘরেই অনেক দিন কাটিয়েছেন কবি নজরুল। ঘরটির সামনের কিছুটা অংশজুড়ে লেপে দেওয়া উঠান। পাশেই অবহেলায় শুকিয়ে যাওয়া এক ছোট পুকুর। ঝরে পড়া পাতা ও আগাছায় ঢেকে গেছে পুকুরটি। বাড়ির অদূরেই ভৈরব নদী।
বাড়িটির ইতিহাসে আসা যাক। বাড়িটি ছিল শিক্ষক ও রাজনীতিক শ্রী হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের। তিনি ছিলেন অখণ্ড ভারতের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং স্বদেশী আন্দোলন ও কংগ্রেসের নেতা। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় তৎকালীন রাজনৈতিক, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাড়িটি। এটি ছিল অনেকটা স্বদেশি আন্দোলনের নেতাদের বৈঠকখানা। একই সঙ্গে বিশ্রামাগার হিসেবেও ব্যবহৃত হতো বাড়িটি।
এখানেই ১৯২৬ সালে সপরিবারে এসেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কলকাতাপ্রবাসী মহিম সরকারের আমন্ত্রণে এই এলাকায় আসেন তিনি। সে বার অবস্থান করেছিলেন দুমাস। এখানে স্থানীয় নেতা হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের সঙ্গে বেশ সখ্য গড়ে ওঠে কবির। তাঁর এই আটচালা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হয় কবিকে। কবি এখানে একাধিকবার এসেছিলেন বলে জানা যায়। পুরোনো লাল ইটের দর্শনা রেলওয়ে স্টেশন বাড়িটি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। জানা যায়, ট্রেনেই দর্শনা স্টেশনে আসতেন নজরুল। তারপর গরুর গাড়িতে করে এ বাড়িতে আসতেন।
বিস্তারিত জানতে দারস্থ হতে হলো হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের দৌহিত্র প্রকৃতি বিশ্বাস বকুলের কাছে। অকপটেই তিনি বাড়িকে কেন্দ্র করে নজরুলের গল্পগুলো বলে গেলেন। তিনি জানালেন, নজরুল এখানেই রচনা করেছিলেন তাঁর কালজয়ী কিছু ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। ‘বাবুদের তাল-পুকুরে/ হাবুদের ডাল-কুকুরে/ সে কি বাস করলে তাড়া/ বলি থাম একটু দাঁড়া’—এ পঙক্তিগুলো হয়তো সবারই পড়া। এ পঙক্তিগুলো তথা ‘লিচুচোর‘ কবিতাটি কবি এখানেই রচনা করেছিলেন। নজরুলের ‘পদ্মগোখরা‘,‘মৃত্যুক্ষুধা‘ ইত্যাদির মতো কালজয়ী রচনার সাক্ষীও এ বাড়ি। তবে অনেকের মতে, এ অঞ্চলের ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে রচনাগুলোর বিষয়বস্তু খুঁজে পেয়েছেন তিনি।
এখানে সংরক্ষিত আছে নজরুলের ব্যবহৃত খাট ও আলমারি। হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের উত্তরসূরিরা যত্নেই লালন করে যাচ্ছেন কবির স্মৃতিচিহ্নগুলো। নিয়মিত সংস্কারের কাজে নিজেদের অনেক ব্যয়ও বহন করতে হয়।
শুধু সাহিত্যজীবনে নয়, নজরুলের রাজনৈতিক জীবনের গল্পও জড়িয়ে আছে এ বাড়িকে কেন্দ্র করে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবেই অংশগ্রহণ করেছিলেন কবি নজরুল। শোষিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনে, সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন তিনি। এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও এসেছিলেন কবি নজরুল। তিনি বিপ্লবী কাজে ব্যবহার করেছিলেন ঘরটি। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে করেছেন অসংখ্য বৈঠক। হুলিয়া জারি হলে এ বাসায় এসে কয়েকবার অবস্থানও নিয়েছিলেন তিনি।
আজ সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশে আটচালা ঘরই হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ঘর নজরুলের স্মৃতি বহন করে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। জাগতিক বিচ্ছেদের পরও নজরুল তাঁর কর্মে বেঁচে আছেন মানুষের হৃদয়ে। আর এ আটচালা ঘর তাঁর অস্তিত্বের জানান দিতে স্বমহিমায় আজও দাঁড়িয়ে আছে।