বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধে
আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে চা বাগানের পথ ধরে। আমরা চলছি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী ধলই চা বাগানে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধের দিকে। ঝিনাইদহে জন্ম নেওয়া বীর সন্তান হামিদুর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সাহসী সিপাহি ছিলেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে হামিদুর রহমান সিলেটের শ্রীমঙ্গল এলাকায় যুদ্ধ করেছিলেন। ২৮ অক্টোবর সকালে দলের অধিনায়কের নির্দেশে হামিদুর রহমান ধলই বিওপিতে পাকিস্তানিদের ঘাঁটি দখলের জন্য অগ্রসর হন। হালকা একটি মেশিনগান নিয়ে জীবন বাজি রেখে হামিদুর রহমান একাই দুটি পাকিস্তানি যুদ্ধ-ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেন। এতে শত্রুঘাঁটির অধিনায়ক এবং বেশ কয়েক জন সৈন্য নিহত হয়। একসময় যুদ্ধরত অবস্থায় এই বীর সন্তান শত্রুদের পাল্টা আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাঁর আত্মত্যাগের কয়েক দিনের মধ্যেই ধলই সীমান্ত ফাঁড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সহযোদ্ধারা হামিদুর রহমানের মৃতদেহ সীমান্তের ওপারে নিয়ে ভারতের আমবাসা গ্রামের একটি মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় এবং ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকার মিরপুরস্থ শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
এই মহান বীরের প্রতি সম্মান জানিয়ে শ্রীমঙ্গল থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে ধলই চা বাগানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। চা বাগান মানেই সবুজের মাঝে ছায়াবৃক্ষের মিলনমেলা। ছোট ছোট টিলায় ভুটান ফুলে হারিয়ে গেল আমাদের মন অনাবিল আনন্দে। হঠাৎ চমকে উঠলাম ছড়ার জলে কলকল ধ্বনি শুনে। গভীর অরণ্যে উপলব্ধি করলাম, আলোছায়ার মায়াময় লুকোচুরি খেলা। দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছালাম গন্তব্যে। দুপাশে চা বাগান রেখে যে রাস্তাটি পাত্রখোলা চা বাগান থেকে আঁকাবাঁকা হয়ে দক্ষিণে গেছে, তার শেষেই সীমান্তরেখা। কাঁটাতারে থমকে দাঁড়ানোর সংকেত।
ওপারে ভারত। ত্রিপুরা রাজ্য। যদিও সীমান্তের এপার-ওপারজুড়ে একই ভাষা। তবু দূরত্ব অপার। দেশমাতৃকার মুক্তির পথে জীবনদানের গল্প আঁকড়ে আছে একটি স্মৃতিসৌধ। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ, নেই কোনো কোলাহল। আমরা খালি পায়ে এগিয়ে চললাম স্মৃতিসৌধের দিকে। চা বাগান পরম মমতায় আগলে রেখেছে স্মৃতিসৌধকে। আমরা কিছু সময় দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানালাম। হামিদুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ প্রদান করা হয়। পাশেই আছে বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ সিপাহি হামিদুর রহমান স্মৃতি আর্কাইভ, যা বাস্তবায়ন করেছে ৪৬ বিজিবি ও শ্রীমঙ্গল সেক্টর। এখানে প্রদর্শিত বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ সিপাহি হামিদুর রহমানের ছোটবেলার ছবি, রয়েছে তাঁর পারিবারিক ছবি। স্মৃতিসৌধের একদিকে বিজিবি ক্যাম্প, অন্যদিকে চা বাগান। দক্ষিণে ভারত সীমান্ত।
যেভাবে যাবেন
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধে যেতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় আসতে হবে। ঢাকা থেকে সরাসরি সড়ক ও রেলপথে শ্রীমঙ্গল আসা যায়। ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। ঢাকার ফকিরাপুল কিংবা সায়েদাবাদ থেকে হানিফ, শ্যামলী, এনা ও সিলেট পরিবহনসহ বিভিন্ন পরিবহনে শ্রীমঙ্গল পৌঁছাতে পারবেন। এ ছাড়া কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেটগামী জয়ন্তিকা, উপবন বা পারাবাত এক্সপ্রেস ট্রেনেও শ্রীমঙ্গল যাওয়া যায়। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে স্থানীয় পরিবহনে (সিএনজিচালিত অটোরিকশা, বাস) চড়ে কমলগঞ্জ এসে রিকশা নিয়ে হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধে যেতে পারবেন।