রোমাঞ্চকর হিরণ পয়েন্ট
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আমার। গায়ে গরম কাপড় চাপিয়ে খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সামনের রাস্তাটুকু বাদ দিলেই ঘন অরণ্যের শুরু। আর একটুখানি সামনের দেয়ালের সঙ্গে লাগোয়া তারকাঁটার বেড়া পার হয়ে ওপারে চোখ রাখলেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অভয়ারণ্য। ভাবতেই গা ছমছম করে উঠল।
কিছুক্ষণের মধ্যে একে একে সবাই উঠে পড়ল। এবার আমরা বনপ্রহরীর সঙ্গে বনের মধ্যে ঘুরতে যাব। বনপ্রহরী নির্দেশনা দিল কিছু।
কেউ যেন লাইন ভেঙে না যাই, একজন আর একজনকে রেখে সামনের দিকে যাওয়া যাবে না, কোনোরকম গল্প করা যাবে না হাঁটার সময়। কোনোভাবেই যেন কেউ দলছুট হয়ে না যাই। একবার একজন আলাদা হয়ে গেলেই আর খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এখানে বাঘের বিচরণ সব সময়, তাই খুব সাবধান। বাঘের খাবার যেন কেউ না হই। এসব শুনেই যেন সবাই ভয়ে কুঁকড়ে গেল।
শুরু হলো সুন্দরবনের মধ্যে পথ চলার এক অন্যরকম রোমাঞ্চ। সবাই লাইন ধরে, একে অন্যের সঙ্গে অনেকটা গা-ঘেঁষে হেঁটে চলেছি। পাখির শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। বন্যপশুরা বনের আরো গভীরে। সবুজ গাছে-ঘাসে, লতায়-পাতায় শুধু শিশিরের ঝরে পড়ার টুপটাপ শব্দ আর গভীর অরণ্য থেকে ভেসে আসা অচেনা পাখির ডাক, কোথাও দু-তিনটি পাখির একত্রে কিচিরমিচির, হয়তো হুট করে অরণ্যের মধ্য দিয়েই ছুটে যাওয়া কোনো শিয়ালের ভয়ে আতঙ্কিত করে তুলেছিল কাউকে।
পথ চলতে চলতে একটা সময় একটা খোলা জায়গা পেলাম, যেখানে কয়েকজন বনপ্রহরীর ছোট আবাস। যদিও ওরা ওখানে সব সময় থাকে না, তবে কোনো প্রয়োজনে ছোট বাড়ির মতো বানিয়ে রেখেছে। সামনেই একটা মাঝারি ধরনের পুকুরের অবস্থান বুঝতে পেরে সেখানে যেতে চাইল অনেকে। যে পুকুরে ছিল অপূর্ব এক সৌন্দর্যের সবকিছুই। ভাগ্যিস বনপ্রহরীকে বলে সেই পুকুরের কাছে যাওয়া হয়েছিল, নইলে এমন অপূর্ব পুকুরের সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হতাম সবাই।
সুন্দরবনের সৌন্দর্য যেন আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল সেই টলটলে জলের লাল শাপলায় ভরা পুকুর। ভাটার টানে পানি কমে যাওয়ায় পুকুরের পানি অনেকটা কমে গিয়েছিল। কিন্তু পদ্মফুলের হাসি ঠিক ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো অরণ্যের চারপাশ। এখানে অরণ্যের ঘনত্ব কিছুটা কম ছিল। পুকুরের চারপাশে অনেকটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে ভয় একটু দূর হতেই অনেকেই ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরতে শুরু করেছিল।
সুন্দরবনের ভেতরে অবস্থিত হাজারো খালের মধ্যে একটা খালের দিকে যেতে শুরু করলাম। আমরা গভীর বনের ভেতরে হাঁটছি, সে পথেই কিছুদূর গিয়ে শেষ হয়ে যাবে খালের পাড়ে গিয়ে। খুব বেশি গভীরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়নি। তাই বলে যে একদমই গভীরে যাব না তেমন নয়। লঞ্চে গিয়ে, সকালের আহার শেষ করেই আমরা যাব এই খালের অনেকটা ভেতরে, একদম সুন্দরবনের যতটা গভীরে যাওয়া যায়, জোয়ার না আসা পর্যন্ত। কারণ জোয়ার এলেই আমরা ফেরার পথ ধরব। কটকার দিকে যাব।