স্বর্গীয় উপত্যকা ভুটানের ফোবজিখা
কয়েলের প্যাচের মতো পাহাড়ি রাস্তা ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠছিল গাড়ি। ভূপৃষ্ঠ ছাড়িয়ে উঠে এসেছে অনেকটা উচ্চতায়। উচ্চতার পরিবর্তনে একটু পরেই কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে সহযাত্রীদের মধ্যে দুজন কিছুটা অসুস্থবোধ করতে লাগল। মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে বিরতি নেওয়া হলো তাদের সুস্থতার কথা বিবেচনা করে। আমি প্রাণভরে উপভোগ করছিলাম প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। দুই পাহাড়ের মাঝে সবেগে বয়ে যাওয়া ঝিরি আর পাহাড় চুঁইয়ে আসা আলতো রোদ এখানে যেন এক স্বর্গীয় আবহ তৈরি করেছে।
রিভার র্যাফটিং, গল্প, গানে কাল পুনাখায় কেটেছিল অসাধারণ দিন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আজ আমাদের গাড়ি ছুটছে ফোবজিখা ভ্যালির উদ্দেশে। থিম্পু শহর থেকে পাহাড়ি পথে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ফোবজিখা। ভুটানের এই দিকটাতে শহুরে আবহ ছাড়িয়ে কিছুটা আদি ভুটানের অনুভব পাওয়া যায়। এ ছাড়া হোমস্টেতে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে থাকার সুযোগ থাকায় ভুটানি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া যায়।
যাত্রাপথে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া হলো এক অতি সাধারণ ভুটানি রেস্তোরাঁয়। মূলত ট্রাকচালকদের আনাগোনাই বেশি এখানে। তবে সস্তায় ভালো মানের খাবার পরিবেশনের সুনাম থাকায় দোকানে বেশ ভিড়। টিভিতে ফুটবল খেলা চলছে, সবাই খাওয়ার সঙ্গে খেলাও উপভোগ করছে। রেস্তোরাঁর মালিক এগিয়ে এসে আলাদা চেম্বারে খাওয়ার বন্দোবস্ত করলেন। রেস্তোরাঁর পাশেই কলকল বেগে বয়ে চলেছে ঝিরি। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাইকে রেখে একফাঁকে চলে গেলাম ঝিরির ছবি তুলতে। এসে দেখি আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে। দেরি করিয়ে দেওয়ার জন্য কেউ কেউ কপট রাগ দেখানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে আবার যাত্রা শুরু হলো।
গাড়ি চলতে চলতে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে দূরের সাদা পাহাড়গুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। যতই ফোবজিখার কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছি, ততই যেন প্রকৃতির সাথে মিশে যাচ্ছি। ঠাণ্ডাও বাড়তে লাগল পাল্লা দিয়ে। শেষ বিকেলে সন্ধ্যা নামার আগে এসে পৌঁছালাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য ফোবজিখা ভ্যালিতে। আসার আগেই ড্রাইভারের মুখে শুনে আসছিলাম এখানকার তরতাজা সবজির কথা, যা আমরা নিজেদের হোমস্টেতেই পাব। ভ্যালির এবড়োখেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে শেষ মাথায় এসে নামলাম আমাদের নির্ধারিত ভুটানি পরিবারের বাড়িতে। পেছনের পাইন বন আর সামনের বিশাল উন্মুক্ত ভ্যালির ভিউ দেখে সবাই উৎফুল্ল হলাম। কিন্তু সে উৎফুল্লতা বেশিক্ষণ টিকল না। বাড়িতে কাউকে না দেখে ফোনে কথা বলে জানা গেল বাড়ির এক বৃদ্ধ পরিজনের মৃত্যুতে সবাই প্রার্থনা করতে গেছে। এমন শোকাবহ সময়ে তারা বাড়িতে অতিথির সমাদর করতে পারবে না বলে অন্য আরেক পরিবারের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। ফিরতি পথে বেশ কিছুটা পথ এসে সেই নির্ধারিত পরিবারের বাড়ি খুঁজে পেলাম। এই বাড়িটা ভ্যালির ব্ল্যাক নেক ক্রেইনের বিচরণক্ষেত্রের ঠিক পাশেই। এখানে একটু বলে রাখা প্রয়োজন যে, ব্ল্যাক নেক ক্রেইন তিব্বত থেকে ফোবজিখাতে ছুটে আসা ভুটানের এক অতিথি পাখি, যা তাদের কাছে পবিত্রতার মূর্তি। এই পাখির আগমন উপলক্ষে ফোবজিখাতে বিশেষ উৎসবেরও আয়োজন করা হয়।
নিজেদের লাগেজপত্র নামিয়ে ঘরে তোলা হলো। আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমগুলো মূলত পুরোনো বাড়ির এক্সটেনশন। নতুন করে সম্ভবত গেস্ট রাখার জন্যই এই অংশ তৈরি করা হয়েছে। বাড়ির কর্ত্রী সবাইকে ডাইনিং রুমের মতো মাঝের কক্ষে আমন্ত্রণ জানালেন চুলার পাশের হিটারের উত্তাপে গা গরম করে ওয়েলকাম টি খাওয়ার জন্য। চায়ের সঙ্গে দেওয়া হলো চৌকোনা সল্টেড বিস্কুট আর চালভাজা টাইপ মুড়ি। সবাই অত্যন্ত আয়েশ করে খেলাম। বাড়িতে এক কিশোর ছাড়া সবাই নারীসদস্য। এর মধ্যে একজন পৌঢ়া ও একজন যাজকও আছেন। বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে মিলেমিশেই চা খাওয়া হলো। ভুটানের অন্যদের মতো এরা ইংরেজি তেমন কেউ পারে না। দোভাষী হিসেবে কাজ করছিল আমাদের ড্রাইভার কিনজং। রাতের খাবারের মেন্যু শুনে অর্ডার করা হলো। নানা রকমের ভুটানিজ শাকসবজির আইটেম সব।
চায়ের পর্ব শেষে গোসলের পরিকল্পনা করেও দ্বিধায় পড়তে হলো বাথরুমের গিজার কাজ না করায়। তবে আমিসহ কয়েকজন দুঃসাহসিক কাজটা করেই ফেললাম এই ভয়ানক ঠাণ্ডায়। অতঃপর সবাই মিলে জমজমাট আড্ডা হলো। এরই মধ্যে ডিনারের সময় হয়ে এলে তারা খবর পাঠাল। চিজ দেওয়া সব লোকাল ভেজিটেবল আইটেমে খাওয়া হলো বেশ। শিম, আলু, পালংশাক সবকিছুতেই চিজের ছড়াছড়ি। বেশ আয়েশ করে খেয়ে রাতে এক কাপ চা খেয়ে আমরা কয়েকজন হাঁটতে বের হলাম। চারদিকে মেঘের আনাগোনা এত বেশি যে আমাদের তারা দেখার পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। ফিরে এসেই তিন লেয়ারের মোটা কম্বলের নিচে মৃতপ্রায় ঘুম হলো।
অ্যালার্মের শব্দে খুব ভোরেই ঘুম ভাঙল। উদ্দেশ্য স্বর্গীয় সকালটাকে উপভোগ করা। এমন ঠাণ্ডায় মোটা কম্বল থেকে বের হওয়াটা খুব যে সহজ ছিল, তা না। তবে রুম থেকে বেরিয়ে দেখি বান্দা আমি একা না। মামুন ভাইও উঠে বসে আছে। প্রিয়াঙ্কাও উঠে ফ্রেশ হচ্ছে। দেরি না করে আমি আর মামুন ভাই বের হয়ে পড়লাম। ব্ল্যাক নেকক্রেইনের খোঁজে ভ্যালির নিচে দেখছিলাম। কিন্তু চোখে না পড়াতে হতাশ হলাম। তবে মেঘে ঢাকা দূরের পাহাড়ি উপত্যকা যেন এক স্বর্গীয় উদ্যানের মতো। বাড়ির গণ্ডি থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম দুজন। ছবিও তোলা হচ্ছিল বেশ। এর মধ্যে দেখা হলো স্কুলগামী কিছু বাচ্চার সঙ্গে। আস্তে আস্তে পাহাড়ের আড়াল থেকে সূর্য উঁকি দিচ্ছিল। আমরাও হোমস্টেতে ফেরার পথ ধরলাম। এসে দেখি হোমস্টের বারান্দায় সবার ফটোসেশন শুরু হয়ে গেছে। ড্রাইভার কিনজংও রেডি গাড়ি নিয়ে। নাশতা রেডি করার কথা বলে আমরা বের হলাম গাড়ি নিয়ে। উদ্দেশ্য পুরো ভ্যালি ঘুরে দেখা। পাকা রাস্তা ছেড়ে বামের পাথুরে পথে গেলাম বেশ খানিকটা। সূর্যের নরম রোদে পুরো ভ্যালি যেন তার রূপ মেলে ধরেছে। দূর থেকেই ড্রাইভার দেখাল ব্ল্যাক নেকক্রেইনের দল। ছবি তোলার জন্য ভ্যালির দিকে কিছুটা এগোতেই দূর থেকে ড্রাইভার কিনজং হন্তদন্ত হয়ে ডাকা শুরু করল। পাখিদের সংরক্ষণের অংশ হিসেবে এখানে যাওয়াটা নিষিদ্ধ এবং সম্ভবত বিশাল অঙ্কের জরিমানার ব্যাপারও আছে। দ্রুতই ফিরে এলাম। দূর থেকেই তোলা হলো পাখির ছবি। আরো কিছু সময় কাটিয়ে অবশেষে হোমস্টেতে এসে হালকা নাশতা সেরে ফেরার প্রস্তুতি নিলাম।
বাড়ির হোস্টদের বিদায় জানিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। মাঝে কিছু জায়গায় বিরতি নিয়ে চলে এলাম গ্যাংটে জং দেখতে। ভ্যালির এলাকা থেকে বেশ উপরের দিকে এর অবস্থান। চমৎকার সুবিশাল স্থাপনা। এখান থেকে ফোবজিখার বেশ ভালো ভিউ পাওয়া যায়। ঘুরেফিরে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে ক্যামেরা নিষিদ্ধ বলে আর বের করিনি। ঘুরে দেখা হলো পুরো জং। অবাক হয়ে যেতে হয় এসব প্রাচীন স্থাপনার নির্মাণশৈলী চিন্তা করে। কিছু ইউরোপিয়ান পর্যটকের সঙ্গেও দেখা হলো এখানে। ফটকের পাশেই বেশ কিছু গিফট শপ আছে। আগ্রহ নিয়ে একটু এগিয়ে পণ্যের আগুনঝরা দাম দেখে থমকে যেতে হলো। মূলত ইউরোপ আমেরিকার পর্যটকদের টার্গেট করে দাম দেওয়া বলেই তা আমাদের মতো সাধারণের সাধ্যের বাইরে। অতঃপর গ্যাংটে জং ছেড়ে ফেরার পথে যাত্রা শুরু হলো। গন্তব্য থিম্পু শহর। থিম্পুতে রাতে থেকে সকালেই আমাদের দেশের পথে যাত্রা শুরু হবে। এক অসাধারণ স্বর্গীয় যাত্রা শেষ হলো।