বিদায় ব্রিটেন
১.
দেখতে দেখতে কেমন করে যে বিয়াল্লিশ দিন কেটে যায়, টেরই পাওয়া যায় না। এখানে পদার্পনের আগে এতগুলো দিন পরিবার পরিজন বন্ধু-বান্ধব ছাড়া কীভাবে কাটাব, তা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু এখানে আসার পর ক্লাসের উপস্থিতি, পেশাগত পরিভ্রমণ, অ্যাসাইনমেন্ট, বিভিন্ন স্থাপনা ও অফিস পরিদর্শন করে সময়গুলো সময়ের নিয়মে অতিবাহিত হতে থাকে। এখন প্রযুক্তির যুগ, যে কারণে পরিজন থেকে দূরে অবস্থান করেও মুঠোফোনের কৃপায় মনে হয়েছে, কাছেই অবস্থান করছি। মিনিটে মাত্র ছয় টাকায় যখন তখন সুদূর ব্রাডফোর্ড থেকে ঢাকায় কথা বলেছি। সময়ের পার্থক্য হেতু স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকায় প্রকাশিত প্রায় সব পত্রিকা ইন্টারনেটে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। এসব প্রযুক্তিগত সুবিধাদির কল্যাণে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও বিচ্ছিন্ন থাকিনি। বন্ধুবান্ধদের থেকে দূরে অবস্থান করেও কাছেই থেকেছি। নাসের ভাইয়ের চায়ের আড্ডাতেও মুঠোফোনের মাধ্যমে হানা দিয়েছি, পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছি। নিজেদের ডাল-ভাত নিজেরাই রন্ধন করে দুখে দুখে দিন গুজরান করেছি।
কিছু দিন অবস্থান করেই শহরটির ওপর কেমন যেন মায়া ধরে যায়। বিদায়কালে তাই বুকের গহিনে চাপা বেদনা অনুভূত হয়। ভেজালহীন খাদ্য, সাধারণ মানুষের ইতিবাচক ম্যানার এটিকেট, আলু-পটোল নিয়ে দামাদামিহীন জীবনাচার, সর্বোপরি অতি উন্নত মানের পরিবহন ব্যবস্থার সুবাদে এই কদিন কেমন যেন একটি অন্য রকম জীবন যাপন করেছি। যে জীবন প্রত্যাশিত, যে জীবন উপভোগ্য, যে জীবন দুশ্চিন্তামুক্ত, সে জীবনের স্বাদ পেয়ে এ শহরের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। কিন্তু ইচ্ছে হলেই তো হবে না, এখানে স্থায়ীভাবে অবস্থানের উপায় নেই। যেতে তো হবেই। তাই সময়ের এক পর্বে বিদায়ের ঘণ্টা বেজে ওঠে। লাগেজভ্যানে মালপত্র লোড করে বিরস বদনে বাসে গিয়ে বসতে হয়। আড়চোখে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থাকি সাময়িক আস্তানা হিটন মাউন্টের দিকে। এখানে আসার সময় আশপাশের গাছগুলোকে যতটা পাতাহীন দেখেছি, বিদায়কালে সেগুলোর অবস্থা আরো বিপর্যস্ত বলে প্রতীয়মান হয়। আসছে শীতে এগুলোর শরীরে হয়তো কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। এরপর চিরায়ত নিয়মে ঋতুচক্রের আবর্তনে আসবে বসন্ত, গাছগুলো আবার স্বমহিমায় উজ্জীবিত হয়ে উঠবে। গাছে গাছে ফুল ফুটবে, পাখিরা উৎফুল্ল হবে, প্রাণ খুলে গান গাইবে। চেয়ে দেখি, কয়েকটি কোকিল অবাক বিস্ময়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কোকিলগুলোকে দেখে কেমন যেন মায়া হয়। মানুষের মতো ওদের শরীরে গরম কাপড় চাপানোর চল নেই। এই শীতে বেচারা পাখিরা কীভাবে টিকে থাকে তা এক বিস্ময়ই বটে। গাছপাখিদের পেছনে ফেলে ছায়াঢাকা অঙ্গন পেরিয়ে উঁচু-নিচু পথ ধরে বাস ছুটতে থাকে ম্যানচেস্টারের পথে। ওখান থেকেই উঠতে হবে দুবাইগামী উড়োজাহাজে, তারপর দুবাই থেকে ঢাকা।
হিটন মাউন্টের সবুজসমৃদ্ধ ছায়াপথ।
যাত্রার নির্ধারিত সময়ের ঘণ্টা দুয়েক আগেই হাজির হই বিমানবন্দরে। আগেই বলেছি, এ দেশে এখন কায়িক শ্রমের জন্য লোক পাওয়া দুষ্কর। সব কাজ নিজেকেই করতে হয়। বিমানবন্দরও এর ব্যতিক্রম নয়। ট্রলি জোগাড় করতে তাই হাঁটতে হয় কিছুটা পথ। ট্রলি গ্রহণের ক্ষেত্রেও এখানে চমৎকার সুবিধা প্রবর্তিত। ট্রলি ব্যবহারের জন্য কোনো পয়সা খরচা করতে হয় না। তবে সাজিয়ে রাখা ট্রলির সারি থেকে তা গ্রহণ করতে হলে এক পাউন্ডের কয়েন ট্রলির পেছনের গহ্বরে প্রবেশ করাতে হয়, প্রয়োজনীয় ব্যবহার শেষে একই কায়দায় পূর্ব অবস্থায় ট্রলিটি রাখার পর পুনরায় প্রদেয় কয়েন ফেরত পাওয়া যায়। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় অটোমেশনের মাধ্যমে। এতে করে ট্রলি-সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়ে থাকে। মালামাল কাউন্টারে দেওয়ার পর, বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশের সময় বহির্গমন কাউন্টারে হতে হয় কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। আগমনের সময় জর্জরিত হতে হয়েছিল প্রশ্নবাণে, বিদায়কালে বিব্রত হতে হয় চেকিংয়ের জ্বালাতনে। জুতা, মোজা, কোমরের বেল্ট, ওয়ালেট, ঘড়ি, ট্রেতে রেখে দাঁড়াতে হয় স্ক্যানিং মেশিনের সামনে, অতঃপর ইতিবাচক রিপোর্টের সুবাদে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি মেলে। এত বিড়ম্বনাকর তল্লাশি রীতিমতো বিরক্তিকর মনে হয়, যে কারণে সবকিছু ঠিকঠাক থাকায় চেকিংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিটি যখন মুখে হাসি ফুটিয়ে এভরি থিং ইজ অলরাইট বলে ইশারায় ভেতরে প্রবেশের জন্য সম্মতি জ্ঞাপন করেন, তখন তাঁকে আর সৌজন্য বশত ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করে না। গাইড লিন্ডা এসেছেন বিদায় জানাতে। বেচারিকে বিমানবন্দরে সারাক্ষণ ছোটাছুটি করতে হয়েছে। আগে থেকে শতবার সতর্ক করার পরও অনেকের লাগেজ ছিল অনুমোদিত ওজনের চেয়ে অনেক বেশি। যে কারণে তাদের এয়ারপোর্টের উন্মুক্ত অঙ্গনে অনেক কিছু ফেলে আসতে হয়। এসব নিয়ে লিন্ডার ঘাম ছোটার উপক্রম। লিন্ডাকে বিদায় জানিয়ে একসময় প্রবেশ করি টার্মিনালের অভ্যন্তরে।
২.
বিমান উড়তে থাকে। মাঝেমধ্যে সেবিকারা এসে চা-কফি দিয়ে যায়। ইউরোপের রুটে দায়িত্ব পালনের সময় সেবিকারা যাত্রীদের তুষ্টির ব্যাপারে বহুমাত্রিক সচেতনতা অবলম্বন করে থাকে। অতঃপর গরিব দেশের রুটে চলাচলের সময় একই সেবিকার সেবার মান কেন যেন স্থবির হয়ে যায়। জেগে থাকার প্রয়োজনে কিছুক্ষণ পর পর চা বা কফি পান করতে করতে মনে পড়ে ব্রাডফোর্ডে অধ্যয়ন করতে আসা বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের কথা। এদের অনেকে এ শহরে পড়ার জন্য পদার্পণ করলেও কিছুদিনের মধ্যেই রুটি-রুজির ধান্ধায় নেমে পড়ে। একে তো এটি একটি ছোট শহর, এখানে তেমন শিল্প-কারখানা নেই, তার ওপর শহরটি অনেকটাই পাকিস্তানি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত, ফলে অন্যান্য দেশের ছাত্রদের কাজ জোগাড় করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।
৩.
একসময় শোনা যেত ব্রিটিশরা খুব গম্ভীর প্রকৃতির, পারতপক্ষে এরা কারো সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলে না। এখন এসব কথা আর ব্রিটিশদের ক্ষেত্রে খাটে না। এরা এখন অত্যন্ত মিশুক প্রকৃতির। সেই প্রভুসুলভ অহমিকা অনেক আগে সমাজজীবন থেকে উবে গেছে। শুধু মিশুক প্রকৃতিরই নয়, হিউমার প্রবণতাও এদের মধ্যে এখন প্রবলভাবে বিরাজমান। কোনো সহযোগিতা চাইলেও এরা সচরাচর বিমুখ করে না। ওয়াটার লু স্টেশন থেকে ব্রিসলি যাওয়ার পথে বিশাল রেলস্টেশনে খেই হারিয়ে ফেলি, অতঃপর এক মহিলার সহায়তায় কাক্সিক্ষত প্লাটফর্মের সন্ধান মেলে। এ ছাড়া লন্ডন মহানগরীর মেট্রো ব্যবস্থা এত জালের মতো বিস্তৃত যে এর আগামাথা কিছুই বোঝা যায় না। এই মহানগরের ১১টা রুটের ট্রেন সার্ভিস বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে অপারেট করা হয়। এক কোম্পানির টিকিট দিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে অন্য কোম্পানির নিয়ন্ত্রিত রুটে চলাচল করা যায় না। যাত্রীদের চলাচলের সুবিধার্থে এসব ট্রেন রুটের ম্যাপ ফ্রি দেওয়া হলেও তা দেখে রুট ও ট্রেন শনাক্তকরণ অনেকটাই দুঃসাধ্য। অনেকবার ট্রেনের দু-একজন যাত্রীকে ম্যাপ দেখিয়ে কাঙ্ক্ষিত রুট বাতলে দেওয়ার অনুরোধ করে দেখেছি, ফলাফল শূন্য। অনেকে খুব গম্ভীর হয়ে ম্যাপে চোখ বুলিয়ে কিছুক্ষণ পর ভেটকি মাছের মতো হেসে স্যরি বলে ম্যাপ ফেরত দিয়েছে। স্ত্রীর ভাই তথা শামিম ভাইয়ের কেন্টের বাড়ি থেকে কিং ক্রস রেলস্টেশনে আগমনকালে এহেন বিব্রতকর অবস্থার মুখোমখি হতে হয়। অতঃপর মেট্রোরেলের ম্যাপখানা ভাঁজ করে সযতনে ব্যাগে পুড়ে খাঁটি বাঙালি হিসেবে যাত্রাপথের সন্ধান করতে থাকি। আসনের বিপরীতে আসীন এক তরুণকে অনুরোধ করতেই সে রুটের ইতিবৃত্ত জানিয়ে দেয়। তার কথামতো লন্ডন ব্রিজ স্টেশনে নেমে রীতিমতো চোখে সর্ষের ফুল দেখতে থাকি। মাটির নিচে এ এক বিশাল সাম্রাজ্য। এখানে প্লাটফর্মের সংখ্যা ১৫টি। বছরে প্রায় ৫৪ মিলিয়ন যাত্রী এই স্টেশন ব্যবহার করে থাকে। এই সাম্রাজ্য পাড়ি দিতে মেশিনে টিকিট পুশ করে পেরুতে হয় একাধিক ব্যারিয়ার। অতঃপর এক ভদ্রলোককে গন্তব্য স্টেশনের কথা বলতেই তিনি ইশারায় মাটির আরো নিচে নামতে বলেন। তাঁর কথামতো সংকীর্ণ পরিসরের এস্কেলেটরে কয়েক ধাপ নামার পর প্রত্যাশিত ট্রেনের নাগাল পাওয়া যায়। পরে জেনেছি, ট্রেন ধরতে প্রায় আশি মিটার পাতালে নামতে হয়েছিল। এভাবেই বিভিন্ন লোকের সহায়তায় একসময় কিং ক্রস টার্মিনালে পৌঁছাতে সক্ষম হই।
৪.
অনেক কথার বাঁকে মনে পড়ে প্রফেসর স্পেন্ডেলার কথা। নাদুসনুদুস প্রকৃতির এই ভদ্রলোক নিজেকে বরাবরই অরিজিন্যাল ব্রিটিশ বলে দাবি করে থাকেন। কিন্তু তাঁর অবয়ব এবং বাচনভঙ্গি ঠিক ব্রিটিশদের মতো নয়, কোথায় যেন কিছুটা বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। তিনি টমেটোকে বলেন তমেতো, ফাইটিংকে উচ্চারণ করেন ফাইতিং। এ ধরনের কথা শুনে মনে সন্দেহ জাগ্রত হয়। মনে হয়, ভদ্রলোক ব্রিটিশ নন, হয় স্প্যানিশ অথবা অন্য কোনো আরব দেশীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা পাঠের সুবাদে অনেকের কাছে আমার কবি পরিচয় পরিজ্ঞাত হয়ে ওঠে। সে সুবাদে একদিন এক ডিনার পার্টিতে একসঙ্গে ভোজন প্রাক্কালে ভদ্রলোক বলেন- তুমি তো কবি তাই না? অনেকটা অবাক হয়ে বলি কবি কি না জানি না, তবে কবিতা লেখার চেষ্টা করি। মুখে খাবার পুরতে পুরতে তিনি বলেন, আমার ছোটবেলা কেটেছে এক কবির সঙ্গে, তুমি হয়তো তার নাম শুনে থাকতে পারো। তার কথায় অতটা গুরুত্ব না দিয়ে কবির নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার বাল্যকাল কেটেছে চিলির কবি পাবলো নেরুয়ার সঙ্গে। (এরা নেরুদাকে নেরুয়া বলে থাকেন) এ কথা শোনার পর তন্ময় হয়ে স্পেন্ডেলার দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থাকি। এরপর আলাপে আলাপে জানা যায়, তার বাবা চিলির শ্রমিক আন্দোলনের নেতা ছিলেন। ছোটবেলায় একপর্যায়ে তার মা বাবাকে ছেড়ে চলে যায়, বাবার তত্ত্বাবধানে অবস্থানকালে একদিন পুলিশ এসে বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। অতঃপর বাবার বন্ধু নেরুদা তাকে তাঁর বাসায় নিয়ে যান। কথায় কথায় নেরুদা সম্পর্কে তিনি অনেক কথাই ব্যক্ত করেন। কীভাবে তাকে হোটেলে নিয়ে খাওয়াতেন, দর্শক সারিতে ঘণ্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রেখে কবিতার অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করতেন। ইত্যাকার নানা বিষয় তিনি স্মৃতি থেকে বের করে বলতে থাকেন। একসময় দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করি, কবি নেরুদার তো অনেক প্রেমিকা ছিল, তুমি কি ওদের কারো কাছে কখনো কোনো প্রেমপত্র পৌঁছে দিয়েছ? এ প্রশ্নের উত্তরে স্পেন্ডেলা মুচকি হেসে জানান, এ ধরনের অনেক মেয়ের কাছে কবির অনেক প্রেমপত্র পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু কখনো কারো কাছ থেকে কোনো উত্তর এসেছে বলে জানা নেই। মুগ্ধ চিত্তে তার কাছে প্রিয় কবির কিস্যা শুনে যারপরনাই প্রীত হই। সেই সঙ্গে এ কথাও জানা হয় যে, তিনি আসলে একজন স্প্যানিশ।
মনে পড়ে ব্রিটিশদের খাওয়াদাওয়ার উপাদানের কথা। এরা ঝাল একেবারেই খায় না। ক্ষেত্রবিশেষে যৎসামান্য গোলমরিচের গুঁড়া খাদ্যে ব্যবহার করে। ঝালজাতীয় কারি খেতে হলে উপমহাদেশীয় রেস্তোরাঁ অভিমুখে ধাবিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বার্গার, ব্রেড, স্যান্ডউইচ এবং ময়দাজাত বিভিন্ন খাবার খেয়েই অভ্যস্ত। এসব খাবারের সঙ্গে মাঝে মাঝে লেটুস পাতা, আলু কিংবা টমেটো খেয়ে থাকে। আমাদের মতো এত বৈচিত্র্যপূর্ণ ডাল, সবজি এবং শাক-লতাপাতা খাওয়ার প্রচলন এদের সমাজে নেই। ঝোলঅলা খাবারও এদের খাদ্যতালিকায় অনুপস্থিত। এ জন্য আমাদের সৌজন্যে দেওয়া অধিকাংশ পার্টিতেই এরা মেরিডিয়ান বা এশিয়ান ফুডের এন্তেজাম করে থাকে। একদিন প্রফেসর জন ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ খাবার তথা ফিস অ্যান্ড চিপস খাওয়াবেন বলে বেশ গর্বিত স্বরে ঘোষণা দেন। প্রফেসরের ঘোষণার নমুনা দেখে মনে হয় এটা কোনো বিশেষায়িত খাবার হবে। মনে মনে সে আশাই পোষণ করে রাখি। নির্ধারিত দিনে এক অভিজাত রেস্তোরাঁতে ফিস অ্যান্ড চিপ্সের আয়োজন করা হয়। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সবার টেবিলে সেই মহার্ঘ্য খাদ্য সরবরাহ করা হয়। বেশ পরিপাটি করে দামি পাত্রে সরবরাহকৃত ফিশের নমুনা দেখে ভিমরি খাওয়ার দশা। এক পাত্রে দেওয়া হয় আলুর চিপস এবং অন্য পাত্রে দেওয়া হয় পরিমিত সাইজের একখণ্ড স্টিম ফিশ। খেতে খুব একটা খারাপ না লাগলেও এ ধরনের খাবার খেয়ে কি বাঙালির পেট ভরে। অগত্যা আধপেট খাওয়ার মতো অতৃপ্তি নিয়েই আয়োজকদের অসংখ্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসতে হয়।
গ্রিনগেট বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে লেখক।
৫.
আকাশযান চলতে থাকে নির্ধারিত গতিতে। এতটা সময় একটানা আকাশ ভ্রমণ রীতিমতো বিরক্তিকর লাগে। কিন্তু উপায় নেই। গন্তব্য না আসা পর্যন্ত গাট্টু মেরে বসে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ফ্রেশরুমে কাজ সেরে সামান্য হাঁটাহাঁটি করে এক কাপ কফির ফরমায়েশ দিয়ে আবার থিতু হই নির্ধারিত আসনে। মনে পড়ে মারিয়ার কথা। ভদ্র মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শান্তি ও দ্বন্দ্ব’ বিষয়ে পড়িয়ে থাকেন। জাতিতে শিখ হলেও তিন পুরুষ ধরে এ দেশে অবস্থানের সুবাদে সে রীতিমতো ইংরেজ বনে গেছে। বিয়ে করেছিল এক ইংরেজ যুবককে, কিছুদিন আগে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ায় এখন একাকী জীবনযাপন করছেন। অনেক সময় তাঁর সঙ্গে লবিতে বসে দীর্ঘ সময় ধরে চলে নানা বিষয়ক বাহাস। এ সমস্ত আলোচনায় একদিন যোগ দেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে মি. রবিন এবং হকিন্স। আলোচনা হয় বৈশ্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে, ইসরাইল বিষয়ে, ইরাক ও আফগানিস্তানের বিষয়ে। একটি ন্যায়সঙ্গত বিশ্ব বিনির্মাণের জন্য করণীয় কী সেসব বিষয়ও আলোচনায় উঠে আসে। যে যারমতো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা করলেও যে বিষয়ে সবাই একমত পোষণ করি তা হলো- প্রশান্তির পৃথিবী বিনির্মাণ করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিশ্ব থেকে দারিদ্র্যের বিতাড়ন। আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের স্বল্প মজুরির প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে মি. রবিন, হকিন্স এবং মারিয়া বেশ বলিষ্ঠ স্বরে জানান দেন যে নামজাদা গার্মেন্টস আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নাকি ন্যায্য মজুরি প্রদানের জন্য প্রবল চাপের মধ্যে রাখা হয়েছে। তারা যেন স্বল্প মজুরিতে পোশাক সামগ্রী প্রস্তুত না করায় সে জন্য নাকি ক্রেতাদের পক্ষ থেকেও তাদের ওপর অহরহ চাপ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। কিন্তু পুঁজির চিরায়ত ধর্ম যে শ্রম শোষণ, মুনাফা বা এভাবে স্বল্প মজুরিতে পোশাক প্রস্তুতের সুযোগ সংকুচিত হলে যে তাদের ক্রেতাদের অধিক মূল্যে সেসব গার্মেন্টস ক্রয় করতে হবে এবং এ ধরনের আরোপিত ব্যবস্থা যে মুক্ত বাজার ব্যবস্থার অনুকূল নয়, এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হলে তখন তাদের কাছে আর সন্তোষজনক জবাব থাকে না। আলোচনা সাময়িক সময়ের জন্য থমকে যায়। তারপরও পাশ্চাত্যের ভাবুকরা যে বিশ্বশান্তির সঙ্গে দারিদ্র্যকে সম্পর্কিত করে ভাবতে পারছে, এ জন্য ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে।
বিমানে উড়ন্ত অবস্থায় এসব নানাবিধ বিষয় ভাবতে ভাবতে এক সময় ভাবনায় ছেদ পড়ে, ভাবতে ভাবতে আট ঘণ্টা পার হয়ে যায়। বিমান বালারা কোমরের বেল্ট বাঁধার জন্য তাগিদ দিতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমান ল্যান্ড করে দুবাইয়ের মাটিতে। এখানে ট্রানজিট দেয় দুই ঘণ্টা। যে কারণে নেমেই দৌড়াতে হয় চেকিং কাউন্টারের দিকে। প্রয়োজনীয় চেকিংয়ের কাজে চলে যায় প্রায় দেড় ঘণ্টা। তারপর আবার গিয়ে বসতে হয় ঢাকাগামী বিমানে। হাজি সাহেবদের কানেকটিং বিমানের বিলম্বতার জন্য নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা পর আকাশের বুকে ডানা মেলে দেয় বিমান। আগের বিমান ও যাত্রীদের বাহ্যিক রূপ এবং পরের বিমান ও তার যাত্রীদের বাহ্যিক রূপ পার্থক্যের স্বরূপ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, দেখিয়ে দেয় ধনিক বিশ্ব এবং গরিব বিশ্বের ফারাক। তারপরও দুবাই টু ঢাকার বিমানে কেমন যেন একটা দেশীয় ফ্লেভার পাওয়া যায়, যা আমাদের সত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি ভোরের আকাশের দিগন্তে। একসময় নজরে পড়ে হিমালয়ের সফেদ অবয়ব। বাড়ি ফেরার তাড়নায় মন উদগ্রিব হয়ে থাকে। দেখতে দেখতে কেটে যায় প্রায় পৌনে পাঁচ ঘণ্টা। সকাল ৯টায় বিমানের চাকা স্পর্শ করে দেশের মাটি। প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সেরে বেরুতে বেরুতে দশটা বেজে যায়। মালামাল চাপিয়ে গাড়িতে বসার পর চালক জানান দেন- মেইন রোড গার্মেন্টসের শ্রমিকরা অবরোধ করে রেখেছে, যেতে হবে আশুলিয়া হয়ে বাঁধের সড়ক ধরে। চালককে প্রশ্ন করে জানা যায়, মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সকাল থেকেই শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে রেখেছে। এরই মধ্যে একটি কারখানায় আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাঁধের সড়ক ধরে যেতে যেতে নজর নিবন্ধিত হয় শরীরে আবিষ্ট এক পাউন্ডে কেনা শার্টের দিকে।
(ভ্রমণকাল ২০১০)