ঘোরাঘুরি
উদ্দেশ্যহীন; জীবনানন্দের পথে পথে
প্রস্তুতি নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ কিংবা কক্সবাজার সেন্টমার্টিন––এটা অনেকেই করে থাকেন। কেউ নিয়মিতই এখানে-ওখানে যান। কিন্তু উদ্দেশ্যহীন যাত্রা বলেও এক কথা আছে।
‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব’––জীবনানন্দ কেন এই কথাটি লিখেছিলেন বা লিখতে পেরেছিলেন, তা জানতে হলে আপনাকে যেতে হবে বরিশাল বিভাগের জেলা শহর ঝালকাঠিতে এবং ঘুরতে হবে উদ্দেশ্যবিহীন; গ্রামের পথে-প্রান্তরে।
এবার ঈদের ছুটিতেও একদিন সকাল সকাল বের হয়ে পড়ি আমরা তিনজন। বন্ধুবর সাইদুলের মোটরসাইকেলে। আরেক সঙ্গী বন্ধু হাসান। ঝালকাঠি শহরের কলেজমোড়ে আমাদের গতিরোধ করে আরো কয়েকজন। তারা জানতে চায় আমার কোথায় যাচ্ছি। বললাম, জানি না। আসলেই আমরা জানতাম না কোথায় যাচ্ছি। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর––এই তিনদিকেই গ্রামাঞ্চল। ফলে যেকোনো দিকে গেলেই হয়। আমরা মহাসড়ক ধরে পশ্চিমে এগোই।
বাসন্ডা খালের ওপর বড় বেইলি ব্রিজ পার হয়ে কীর্তিপাশা মোড়ে গিয়ে ভাবি, ডানে মোড় নিয়ে কীর্তিপাশা জমিদার বাড়ি যাব? কিন্তু ওখানে তো জীবনে বহুবার গিয়েছি। ফলে আমারা ফের পশ্চিমে। একটু গেলেই হাতের বাঁয়ে আমাদের শৈশবের ইছানীল স্কুল। আরেকটু এগোলে পঞ্চম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু।গাবখান নদীর(বস্তুত চ্যানেল) ওপর নির্মিত বলে এটি গাবখান সেতু নামেই পরিচিত।এই সেতুর মাঝখানে দাঁড়ালে আপনি দেখবেন সুগন্ধা আর বিষখালী নদীর মিলনস্থল, তার পাশ দিয়ে ঢুকে গেছে এই গাবখান চ্যানেল। তার পেটের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে গেছে জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি নদী।
সম্ভবত ২০০৪ সালে শিল্পকলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে ঝালকাঠিতে গিয়েছিলেন প্রয়াত শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী, রফিকুন নবীসহ আরো কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। জোছনা রাতে তাঁদের নিয়ে গিয়েছিলাম এই সেতুতে। সেখানে দাঁড়িয়ে তারা দেখেছিলেন নদীর ভয়াবহ সুন্দর রূপ।যখন তাঁরা জানলেন, ওটাই ধানসিঁড়ি নদী এবং যখন তারা এটি দেখলেন এক ভরা পূর্ণিমায়––তখন সেই বয়সী মানুষগুলোর ভেতরে যে আনন্দ আর উদ্বেল আমি দেখেছি, তা এখনো মনে আছে। এই নদীগুলোর সঙ্গমস্থলেই বিশাল এলাকাজুড়ে সবুজ ঘাসের দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, চারপাশে বাবলার গাছ। লোকেরা এটাকে ধানসিঁড়ি ইকোপার্ক বলে চেনে। কোনো এক জোছনা রাতে এই মাঠে এসে দাঁড়ালে আপনার মনে পড়বে জীবনানন্দের সেই কবিতা––‘মহিনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জোছনার প্রান্তরে’।
এসব জায়গায় জীবনে শতবার গিয়েছি। ফলে আমাদের উদ্দেশ্যবিহীন যাত্রার বিরতি এখানে নয়। সেতু পার হয়ে আমরা আরও পশ্চিমে যেতে থাকি। ছাত্রকান্দা নামক স্থানে গিয়ে মনে হলো ডান দিকের গ্রামের রাস্তায় ঢুকে যাই। সেখানে একটি দোকানে চা খেতে খেতে আমরা জিজ্ঞেস করি, এই রাস্তাটা কোথায় গিয়েছে? দোকানি বললেন, কাউখালী অথবা শেখেরহাট––যেকোনো জায়গায় যাওয়া যাবে। আমরা পিরোজপুর উপজেলার কাউখালী টার্গেট করে এগোতে থাকি।
পিচঢালা সরু রাস্তার দুপাশে বাংলার অপরূপ রূপ। হাতের ডানে দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ, বাম পাশে অনিন্দ্যসুন্দর খাল। বরিশাল অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য এই খালগুলো। বছরের কোনো সময়ই এর যৌবনে ভাটা পড়ে না। তবে এই বর্ষা-শরতে পানি তীর ছুঁই ছুঁই। খালের পাড়ে বুনোফুল, তাল-সুপারির গাছ, বড় বড় ঘাস, কোথাও ঘন ছায়া, ছায়া ভেদ করে সূর্যের রোসনাই। তখন আপনি বুঝবেন, কেন জীবনানন্দ ওই কথাটি লিখেছিলেন।
আমরা যখন কাউখালী বাজারে পৌঁছাই তখন দুপুর পৌনে দুইটা। মানে মধ্যাহ্নভোজের পিক টাইম। কোথায় খাব? তিনজন অচেনা যুবককে দেখে এই শহরতলীর মানুষদের কি সন্দেহ হয়? ভাঙাচোরা একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাবারের মেন্যু দেখে পছন্দ হয় না। নদীর পাড়ে গিয়ে আরেকটা দোকানে ঢুকি। দেখা গেলো করলা ভাজি, ছোট চিংড়ি মাছ দিয়ে শশা, সামুদ্রিক লাল পোয়া (স্থানীয়রা বলে মরমা মাছ) আর পাতলা ডাল। দেখেই জিভে জল আসে। আমরা কবজি ডুবিয়ে খাই এবং খাওয়ার পরে কাঠের বেঞ্চিতেই হেলান দিয়ে পড়ি। কিন্তু আমাদের যেতে হবে আরও অজানায়।
কাউখালী বাজারকে বিদায় দেওয়ার পথে আমাদের দেখা হয় কচা নদীর ওপর এক দীর্ঘ বেইলি সেতুর। তার পাশে কংক্রিটের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে জেলেদের মাছ ধরা দেখি। এই ভরদুপুরে কিছু কি উঠল জালে?...
আমাদের যাত্রা উদ্দেশ্যহীন হলেও সন্ধ্যার মধ্যে নিজ শহর ঝালকাঠিতে পৌঁছাতে হবে। সুতরাং এবার আমরা জেনে নিচ্ছি এখান থেকে কোন পথে গেলে ঝালকাঠি সহজ।
সেই পথে ধরে আমাদের পুনরায় যাত্রা শুরু। এবারও পিচঢালা সরু পথে চলতে চলতে আমরা এক সময় পৌঁছে যাই ঝালকাঠি সদর উপজেলার শেখেরহাট ইউনিয়নে। এখানে যাত্রাবিরতি এবং রাস্তার মোড়ে একটি দোকানে গরুর দুধের ঘন চায়ের ঘ্রাণ আমাদের মাতাল করে। এমন সুস্বাদু চা সবশেষ কবে পান করেছি মনে নেই।
আমরা যাত্রা করি পুবদিকে। কিছুদূর যেতে হাতের বাঁয়ে নদী তীরে একটি অদ্ভুত সুন্দর শানবাঁধানো ঘাট আর তার পাশে ঘন সবুজের সমারোহ দেখে আমরা সেখানে দাঁড়ানোর লোভ সামলাতে পারি না। সেখানে সবুজ ঘাসের ভেতরে বসে এবং শুয়ে আমরা জীবনানন্দের কথা মনে করি।
এখান থেকে গাবখান চ্যানেলের পাড় দিয়ে সরু পিচঢালা পথে যেতে যেতে আমরা পেয়ে যাই গাবখান বাজার। শেষ বিকেলে এই বাজারে মানুষের আনাগোনা আর খালের এপার-ওপার তাদের পারাপারের দৃশ্য যেন এক মায়াজাল সৃষ্টি করে।
এখানে থেমে আমরা চা খা্ই। সূর্যটা ডুবে গেলে ‘অদ্ভুত আঁধারে’ আমরা মোটরসাইকেলের হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে চলে যাই শহরে; যে যার বাসায়।
যেভাবে যাবেন
এই যাত্রাটা আপনিও করতে পারেন। ঝালকাঠি শহরের কলেজমোড় থেকে ভাড়ায় মোটরসাইকেল পাবেন। অথবা বিভিন্ন রুটে চলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা অথবা এ রকম আরো কিছু স্থানীয় বাহন। ভাড়া খুবই কম। উদ্দেশ্যবিহীন উঠে পড়বেন এবং যেখানে খুশি নেমে যাবেন। ঝালকাঠি জেলা শহরটি এতই সুন্দর যে, আপনি যেখানে নামবেন, সেখানেই ভিন্ন ভিন্ন সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। ঢাকা থেকে যেতে চাইলে সদরঘাট থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় লঞ্চ। অথবা গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল, দুপুর, বিকেল ও রাতে বিভিন্ন কোম্পানির বাস। যদি ঝালকাঠি শহরে প্রথমবার যান এবং সেটি হয় বর্ষা-শরৎকাল, তাহলে অবশ্যই আপনাকে পেয়ারাবাগানেও যেতে হবে। ঝালকাঠি শহরে থাকার মতো খুব ভালো আবাসিক হোটেল নেই। যেগুলো আছে, মোটামুটি চলনসই। তাই আপনি চাইলে সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে রওনা হয়ে পরদিন সারাদিন ঘোরাঘুরি করে ওইদিন সন্ধ্যায়ই আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা হতে পারেন।