স্মৃতিতে সংরক্ষিত শহীদ রুমি
ক্র্যাক প্লাটুন। স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি নক্ষত্রের নাম। বাংলার গেরিলা যুদ্ধের পথিকৃৎ। আর এই গেরিলা দলের অন্যতম সদস্য শহীদ শফি ইমাম রুমি। ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়ার সুযোগকে পেছনে ফেলে দেশমাতৃকার ডাকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া অদম্য বীর শহীদ শফি ইমাম রুমির জন্ম ১৯৫২ সালের ২৯ মার্চ।
এই বীরের বীরত্বগাঁথার স্মৃতি দেখতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর থেকে। ঢাকার পুরোনো এলিফ্যান্ট রোডে ৩৫৫ নম্বর ‘কনিকা’ বাড়িটি এখন শহীদজননী জাহানারা ইমাম আর শহীদ রুমীর স্মৃতি বহন করছে।
মুক্তিযুদ্ধে ইমাম পরিবারের ভূমিকা, যুদ্ধে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান সম্পর্কে অবহিত করা এবং যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার লক্ষ্য নিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় এ জাদুঘর। শহীদজননী জাহানারা ইমামপুত্র ও শহীদ রুমির কনিষ্ঠ ভ্রাতা সাইফ ইমাম জামির সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ২০০৭ সালের ২৪ জুন ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে কার্যক্রম শুরু করে এ জাদুঘর। জাদুঘরে ইমাম পরিবারের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, শহীদ জননীর এবং শহীদ রুমির নানাবিধ সম্মাননা এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র খুব সহজেই দর্শনার্থীদের মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। আগরতলা থেকে নিজের ছোট মামাকে লেখা টিঠি, রুমির জন্মদিনে উপহার পাওয়া এয়ারগান, ব্যবহৃত তবলা, রুমির স্কুলজীবনের ছবি, নানাবিধ সম্মাননা-পদক, নিজ মাকে নিয়ে করা রুমির উক্তিসমূহ একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধার প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে। প্রতিবছর দেশি-বিদেশি শিশু-কিশোর-নারী-পুরুষ, সব মিলিয়ে প্রায় ৬০০-৬৫০ দর্শনার্থী জাদুঘর পরিদর্শন করে থাকেন। দর্শনার্থীরা জাদুঘরের মন্তব্য খাতায় তাঁদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
বেশির ভাগ দর্শনার্থীই শহীদজননীর প্রতি শ্রদ্ধা, শহীদ রুমির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার আশা ব্যক্ত করেন। দর্শনার্থীদের জন্য জাদুঘর প্রতি শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দিবসে জাদুঘর খোলা থাকে। দর্শনার্থীরা কোনোরকম দর্শনী ছাড়াই এ জাদুঘরে প্রবেশ করতে পারবেন। জাদুঘরটি একটি বড় হলরুম এবং এর সঙ্গে ছোট একটি রুমের ভেতরে পরিচালিত হয়। ছোট রুমটি প্রদর্শনী রুমের পাশাপাশি অফিস রুম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
জাদুঘর পরিচালিত হয় একজন সভাপতি, একজন তত্ত্বাবধায়ক এবং তিনজন সহযোগী তত্ত্বাবধায়ক দ্বারা। সহযোগী তত্ত্বাবধায়করা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে দর্শনার্থীদের জাদুঘরের বিভিন্ন দর্শনীয় বস্তুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁদের নিরলস পরিশ্রম সত্যি প্রশংসনীয়। জাদুঘরের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাইফ ইমাম জামি। জাদুঘর পরিচালনায় কোনো রকম সরকারি অথবা বেসরকারি সহযোগিতা গ্রহণ করা হয় না। জাদুঘরের নিয়মিত কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে শহীদজননীর মৃত্যুবার্ষিকী পালন এবং শহীদ রুমির জন্মবার্ষিকী পালন। শহীদজননীর মৃত্যুবার্ষিকীতে আলোচনা সভার পাশাপাশি মসজিদে দোয়া মাহফিল ও এতিমখানায় শিশুদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়।
শহীদ রুমির অন্তর্ধান দিবস সম্বন্ধে সঠিক তথ্য না জানায় তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয় না। এ ছাড়া জাদুঘরের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে গ্রন্থাগার কর্মসূচি, নিজস্ব প্রকাশনা, বই বিক্রয়, বিশেষ দিবস পালন, পরিদর্শন কর্মসূচি, আউটরিচ প্রোগ্রাম ইত্যাদি। আউটরিচ প্রোগ্রামের আওতায় কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য স্কুল শিক্ষার্থীদের কাছে জাদুঘরের কার্যক্রম পৌঁছে দেওয়া। অদূর ভবিষ্যতে নিজেদের কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য জাদুঘর কর্তৃপক্ষ একটি ওয়েবসাইট প্রকাশ করতে যাচ্ছে।
জাদুঘরের গ্রন্থাগারে স্থান পেয়েছে শহীদজননী জাহানারা ইমাম রচিত গ্রন্থ, জাহানারা ইমামের সংগ্রহে থাকা গ্রন্থাবলি এবং জাদুঘর কর্তৃপক্ষ প্রকাশিত গ্রন্থাবলি। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থও আছে এ গ্রন্থাগারে। উৎসাহী পাঠক এবং তরুণ গবেষকরা খুব সহজেই এখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা বিষয়ে অধ্যয়ন করতে পারেন।
শহীদজননী জাহানারা ইমাম ও তাঁর পরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র সংরক্ষণ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখানে প্রদর্শিত আলোকচিত্র এবং তথ্যগুলো শুধু সন্তানের জন্য এক মায়ের আকুতিই নয়, বরং প্রতিফলিত করছে একাত্তরের পরাজিত শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতার চেতনা। যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস অনুধাবনে এবং পাশাপাশি একাত্তরের ঘাতকচক্রের স্বরূপ উদঘাটনে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
জাদুঘরের ঠিকানা : কনিকা, বাড়ি-৩৫৫, শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মরণি, পুরোনো এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা।
পরিদর্শন সময় : প্রতি শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা।
তথ্য ও ছবিসূত্র : জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।