ঈদে ঘোরাঘুরি
মোগল স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন লালবাগ কেল্লা
আমরা বাঙালিরা ভ্রমণবিলাসী। ভ্রমণের তাড়নায় ঘুরে বেড়াই দেশ-বিদেশে; কিন্তু দেশের অনেকাংশেই আমরা ঘুরে দেখি না। এমনকি আমরা অনেকেই জানি না, ব্যস্ত এই নগরীতেই লুকিয়ে আছে অনেক ঐতিহাসিক স্থান। এই নগরীর ভাঁজে ভাঁজেই লুকিয়ে রয়েছে নানা গুপ্তরহস্য। আজ আমরা আমাদের ঢাকার তেমনি এক ঐতিহ্যবাহী রূপের বর্ণনা করব।
লালবাগ কেল্লা মোগল আমলের বাংলাদেশের একমাত্র ঐতিহাসিক নিদর্শন, যাতে একই সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে কষ্টিপাথর, মার্বেল পাথর আর নানান রঙ-বেরঙের টালি। লালবাগ কেল্লা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো ঐতিহাসিক নিদর্শনে এমন বৈচিত্র্যময় সংমিশ্রণ পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত। লালবাগ কেল্লা পুরান ঢাকার লালবাগে অবস্থিত।
লালবাগ কেল্লার নামকরণের ইতিহাস
লালবাগ কেল্লার নির্মাণ ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, লালবাগ কেল্লার নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র মুহাম্মদ আজম শাহ। তিনি বুড়িগঙ্গার তীরে এক প্রাসাদ-দুর্গ নির্মাণকাজে হাত দেন। পিতার নামানুসারে এর নাম রাখেন আওরঙ্গবাদ কেল্লা বা আওরঙ্গবাদ দুর্গ। পরবর্তী সময়ে নাম হয় লালবাগ কেল্লা। অনেকে মনে করেন, এ এলাকায় লাল গোলাপের বাগান ছিল। সেই থেকে এলাকার নাম এবং এলাকার নামে নামকরণ হয় লালবাগ কেল্লার।
তিনশ বছরের ঐতিহ্য বহন করে আছে এই দুর্গ। ধ্বংস, ক্ষয় আর চরম অবহেলার পরও যা অবশিষ্ট আছে তার স্থাপত্য কৌশল, ঐতিহ্য আর সৌন্দর্যের কারণে এখনো তা জনসাধারণের কাছে দর্শনীয় স্থান। কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে কেল্লার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। লালবাগ কেল্লায় রয়েছে পাতাবাহার আর ঝাউগাছের সারি। রঙ্গন, গোলাপ, গাদাসহ রকমারি ফুলের গাছ।
লালবাগ কেল্লার ইতিহাস
লালবাগ কেল্লার নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৬৭৮ সালে। তৎকালীন মোগল সম্রাট আজম শাহ এর নির্মাণকাজ শুরু করেন। যদিও আজম শাহ খুব কম সময়ের জন্যই মোগল সম্রাট ছিলেন। তবুও অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তার এই অসাধারণ কাজটি শুরু করেন। উল্লেখ্য, আজম শাহ ছিলেন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র আর সম্রাট শাহজাহানের নাতি, যিনি তাজমহল তৈরির জন্য বিশ্বমহলে ব্যাপক সমাদৃত।
এই দুর্গ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার প্রায় এক বছরের মাথায় তাঁর বাবার ডাকে তাঁকে দিল্লিতে চলে যেতে হয় সেখানকার মারাঠা বিদ্রোহ দমন করার জন্য। সম্রাট আজম শাহ চলে যাওয়ার পর দুর্গ নির্মাণের কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তখন এই দুর্গ নির্মাণের কাজ আদৌ সম্পূর্ণ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তৎকালীন নবাব শায়েস্তা খাঁ পুনরায় লালবাগ কেল্লার নির্মাণকাজ শুরু করেন। প্রায় এক বছর পর পুরো উদ্যমে আবার কাজ চলতে থাকে দুর্গ নির্মাণের।
তবে শায়েস্তা খাঁ পুনরায় কাজ শুরু করার প্রায় চার বছরের মাথায় দুর্গের নির্মাণকাজ আবার বন্ধ হয়ে যায়। এর পর দুর্গটি নির্মাণের কাজ আর শুরু করা হয়নি। নবাব শায়েস্তা খাঁর মেয়ে পরী বিবি মারা যাওয়ার কারণেই মূলত শায়েস্তা খাঁ লালবাগ কেল্লার নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন। পরী বিবির সঙ্গে শাহজাদা আজম শাহের বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল। পরী বিবির মৃত্যুর পর সবার মধ্যে দুর্গটি সম্পর্কে বিরূপ ধারণা জন্ম নেয়, সবাই দুর্গটিকে অপয়া ভাবতে শুরু করে দেয়।
পরী বিবির মৃত্যুর পর তাঁকে লালবাগ দুর্গের মাঝেই সমাহিত করা হয়, আর এর পর থেকে একে পরী বিবির সমাধি নামে আখ্যায়িত করা হয়। পরী বিবির সমাধির যে গম্বুজটি আছে, তা একসময়ে স্বর্ণখচিত ছিল, কিন্তু এখন আর তেমনটি নেই, তামার পাত দিয়ে পুরো গম্বুজটিকে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
দেখার মতো যা যা আছে
লালবাগ কেল্লার তিনটি বিশাল দরজার মধ্যে যে দরজাটি বর্তমানে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া, সেই দরজা দিয়ে ঢুকলে বরাবর সোজা চোখে পড়বে পরী বিবির সমাধি। লালবাগ কেল্লা চত্বরে আরো রয়েছে দরবার হল ও হাম্মামখানা, উত্তর-পশ্চিমাংশের শাহি মসজিদ। ঢাকায় এত পুরোনো মসজিদ খুব কমই আছে।
লালবাগ কেল্লার দরবার হল ও হাম্মামখানাটি বর্তমানে সর্বসাধারণের দেখার জন্য একটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে, যা পূর্বে নবাব শায়েস্তা খাঁর বাসভবন ছিল আর এখান থেকেই তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। জাদুঘরটিতে দেখার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। মোগল আমলের বিভিন্ন হাতে আঁকা ছবির দেখা মিলবে সেখানে, যেগুলো দেখলে যে কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারবে না। জাদুঘরে রয়েছে মোগল আমলের পাণ্ডুলিপি, মৃৎশিল্প, কার্পেট, হস্তলিপি ও রাজকীয় ফরমান। শায়েস্তা খাঁর ব্যবহার্য নানান জিনিসপত্রও সেখানে সযত্নে আছে। তা ছাড়া তৎকালীন বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, পোশাক, সে সময়কার প্রচলিত মুদ্রা রয়েছে জাদুঘরে। তিনশ বছরের পুরোনো স্থাপনা ও সে সময়ের সম্রাটের ব্যবহৃত নানা জিনিস দেখতে পারাটা সৌভাগ্যের, সে সঙ্গে বিস্ময়েরও বটে। লালবাগ কেল্লায় সম্রাটের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখতে দেখতে আপনিও হারিয়ে যাবেন মোগল শাসকদের আমলে।
বন্ধ-খোলার সময়সূচি
গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কেল্লা খোলা থাকে। আর শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। রোববার পূর্ণ দিবস, সোমবার অর্ধদিবস কেল্লা বন্ধ থাকে। এ ছাড়া সব সরকারি ছুটির দিন লালবাগ কেল্লা বন্ধ থাকে।