ছুটির দিনে
সাদা মাটি আর সবুজ হ্রদের দেশে
অজানা সৌন্দর্যের টানে ঘুরতে যাওয়ার আহ্বান মানব মনে সবসময়ই হাতছানি দেয়। ইট, কাঠ, পাথর আর কর্মব্যস্ততার এই শহরের একঘেয়েমিতে মানব মনে ছোঁয়া লাগে অলসতার। একঘেয়েমি আর কৃত্রিমতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য ভ্রমণ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। শহরের এই বেড়াজাল পেরিয়ে একটু দূরে কোথাও খোলা হাওয়ায় যেতে পারলে মনের প্রশান্তি আর ভ্রমণের মজা দুটোই পাওয়া যায়। কর্মব্যস্ততা আর শহরের একঘেয়ে জীবন ছেড়ে আপনিও বেড়িয়ে চলুন প্রকৃতির সন্ধানে। আসছে পুজোর ছুটিতে নিজে এবং পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলুন না ঘুরে আসা যাক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমিতে। অপার সৌন্দর্যের এই বাংলাদেশের যেসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখনো অনাবিষ্কৃত প্রায় তার মধ্যে বিরিশিরি অন্যতম। “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া” কবি গুরুর এই পঙ্ক্তি দুটি শুধু তাঁদের জন্য যাঁরা 'বিরিশিরি'র সৌন্দর্য এখনো দেখতে যাননি। ঢাকা থেকে মাত্র ১৮০ কিলোমিটার উত্তরে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত বিরিশিরি। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা বিরিশিরিতে রয়েছে প্রকৃতির ঢেলে দেওয়া সৌন্দর্য। ছবিপ্রেমীদের কাছে রাজকন্যার মতো স্থান করে নিয়েছে এই বিরিশিরি। অনেকে একে সাদা মাটির দেশও বলে থাকেন। নদী, পাহাড় আর সবুজের এই বিরিশিরিতে রয়েছে কালচারাল একাডেমি, জাদুঘরসহ অনেক কিছু।
সোমেশ্বরী নদী
বিরিশিরির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যমণি বলা যায় সোমেশ্বরী নদীকে। চারপাশে পাহাড়ে ঘেরা সোমেশ্বরীকে বলা যায় প্রশান্তির আরেক নাম। উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথেই তার পানির রংও পাল্টায়। গ্রীষ্মের মৌসুমে হেঁটে পার হওয়া গেলেও বর্ষায় কানায় কানায় পূর্ণ থাকে সোমেশ্বরী। আর ঠিক তখনই বিরিশিরির সৌন্দর্য বেড়ে যায় প্রায় কয়েক গুণ। ধীরগতির এই নদী পারাপারের জন্য রয়েছে নৌকাও।
বিরিশিরিতে দেখা যায় বহু ধরনের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। এখানে দেখতে পাবেন বনই, বুনা, গারো, মান্দি আর হাজং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। গারো ও হাজং ছাড়া প্রায় সবকটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীই বাংলা ভাষাভাষি। এখানকার বেশির ভাগ কর্মজীবী লোকই গারো আর হাজং। কালচারাল একাডেমির পাশেই পাবেন তেভাগা আন্দোলনের কিছু স্মৃতিস্তম্ভ। রয়েছে বিরিশিরি কালচারাল একাডেমি। রয়েছে একটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাদুঘরও; যা কি না এই অঞ্চলের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে আপনাকে বেশ সাহায্য করবে। জাদুঘরের দুটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরিতে পাবেন পাহাড়িদের লেখা বই ও জার্নাল। এখান থেকে নিয়মিত একটি সাময়িকীও প্রকাশ করা হয়। পথে পেয়ে যাবেন সেন্ট যোসেফের গির্জা। নীরব, ছিমছাম, পরিপাটি আর সুন্দর এই গির্জায় ঠায় জুড়িয়ে যাবে মন নিমেষেই।
বিজয়পুর চীনামাটির পাহাড় ও নীল হ্রদ
এরপরই পৌঁছে যাবেন বিজয়পুর সীমান্ত ঘেঁষা সাদামাটির পাহাড় বা দুর্গাপুর চীনামাটির পাহাড়। একে বলা হয় বিরিশিরির সৌন্দর্যের প্রাণ। সাদা, ধূসর আর খানিক লালচে রঙের এই পাহাড়ের নিচে জমে থাকা সবুজ পানির অপরূপ সৌন্দর্য সেন্টমারটিনসের গভীর নীল পানিকেও হার মানায়। পানিতে চোখ পড়তেই দেখবেন আপনার সব কষ্ট কোথায় যেন বিলীন হয়ে গেছে। চারপাশের সাদা মাটি যেন পানির রংটাকে আরো গাঢ় করে দিয়েছে। আর এই বিজয়পুর পাহাড়ের পাদদেশ ধরেই বয়ে গেছে সোমেশ্বরী।
গোপালপুর পাহাড় ও রাণীখং গির্জা
দুর্গাপুর থেকে ছয় কিলোমিটার উত্তর সীমান্তেই গোপালপুর পাহাড়। গোপালপুর পাহাড় থেকেও দেখা যায় বিজয়পুর সীমান্ত এবং দুর্গাপুরের চীনামাটির পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে রাণীখং গির্জা। এটিও বেশ মনোরম পরিবেশ নিয়েই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের মণি হয়ে। গোপালপুর পাহাড়ের চূড়া থেকে দেখলে বিরিশিরির সৌন্দর্যের অন্য এক মাত্রা খুঁজে পাওয়া যায়।
কমলারাণীর দীঘি
বিরিশিরি ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই রয়েছে কমলা রাণীর দীঘি। অনেকে একে সাগরদীঘি নামেও চেনেন। এর বেশির ভাগ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও কিছু অংশ এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে।
ঘুরে দেখার মতো আরো আছে রাজা সুসংয়ের রাজমহল- যার নামানুসারে এই উপজেলার নামকরণ করা হয় সুসং দুর্গাপুর। কুলাপাড়ার নিকটে আছে দাশা-বুশা মন্দির, রামকৃষ্ণ মন্দির এবং লোকনাথ মন্দির। কমলা বাগান আর দারুচিনি বাগানের ঘ্রাণ মুহূর্তেই আত্মভোলা করে ফেলতে পারে পর্যটকদের। নিরিবিলি কোলাহল বিহীন ছিমছাম শান্ত পরিবেশ সবসময়ই মনে জোগায় প্রশান্তি। এমন পরিবেশে বসে থাকতে থাকতে চোখ জুড়াবে না অথচ কখন যে সময় চলে যাবে তা আপনি টেরই পাবেন না।
বিরশিরির প্রায় সবকটি জায়গাই রিকশা কিংবা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে করে ভ্রমণ উপযোগী। এখানকার স্থানীয় রিকশাচালকরা দর্শনীয় সবকটি স্থানই চিনে। খুব অল্প খরচেই সবকটি স্থান ঘুরে ফেলতে পারবেন। তবে পর্যটক হিসেবে একটু দরদাম করে নেওয়াই ভালো।
কীভাবে যাবেন
মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি নেত্রকোনা। ভাড়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন দুর্গাপুর। সেখান থেকে বাস বা সিএনজিতে মাত্র ২৫ মিনিটের পথ বিরিশিরি। মহাখালী থেকে সরাসরিও যেতে পারেন দুর্গাপুর। খেয়াল রাখতে হবে শেষ তিন কিলোমিটার পথ খুবই উঁচুনিচু এবং ভঙ্গুর। তাই সরাসরি না যাওয়াই ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভালো।
কোথায় থাকবেন
দুর্গাপুরে রয়েছে হোটেল। এসি/নন এসি সব ধরনের হোটেলই রয়েছে। তবে এগুলো মোটেই সস্তা নয়। বিরশিরিতে থাকতে হলে আপনাকে কালচারাল একাডেমির গেস্ট হাউজ কিংবা ওয়াইএমসি নামক প্রতিষ্ঠানের আশ্রয় নিতে হবে। এ ছাড়া থাকার জন্য খাটিয়ে নিতে পারেন তাঁবু।
কী খাবেন
বিভিন্ন মধ্যমানের রেস্টুরেন্টে ভাত, ডাল থেকে শুরু করে সব ধরনের মাছ আর মাংসই পাবেন বিরিশিরিতে। পাবেন বকের মাংস। তবে বিভিন্ন উপজাতি অঞ্চলগুলোতে নানা ধরনের খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলো তাদের বাড়ি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।
তবে আর দেরি কেন? চলুন ঘুরে আসা যাক সাদা মাটি আর সবুজ হ্রদের দেশ বিরিশিরিতে।