ছুটির দিনে
ঐতিহাসিক কান্তজি মন্দির
কাজের চাপে নাকাল হয়ে অনেকেই ছুটে যেতে চান শহর থেকে দূরে কোথাও। সুখবর হলো সামনেই আসছে পূজার ছুটি। এই ছুটিতে চলে যেতে পারেন উত্তরবঙ্গে।
তাই পূজার ছুটিতে আপনি সিদ্ধান্ত নিন উত্তরবঙ্গ বেড়াতে যাবেন। উত্তরবঙ্গে প্রথমেই ঘুরবেন কোথায় এই ভাবনাটা মাথায় আসতেই সর্বপ্রথমেই হয়তো আপনার মনে হবে কান্তজি মন্দিরটাই আগে দেখে ফেলা উচিত। কান্তজির কথা মনে হবেই বা না কেন? এত চমৎকার স্থাপত্য বাংলাদেশে খুব কমই আছে। হ্যাঁ হয়তো এটা ঠিক যে বাংলাদেশে আছে হাজার বছরের সব স্থাপত্য যেগুলো, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে, কিন্তু কান্তজি হলো এমন একটি স্থাপত্য যেটি আপনাকে শুধু এই অঞ্চলের ইতিহাসই নয়, একই সঙ্গে হিন্দুধর্মের পৌরাণিক জগতেও আপনাকে নিয়ে যাবে।
যা হোক, আপনাকে তাহলে কান্তজির মন্দির সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে দিই। কান্তজির মন্দির দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নে টেপা নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির, যা দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র ১৪ মাইল উত্তরে। মন্দিরটি হিন্দুধর্মের কান্ত বা কৃষ্ণের মন্দির হিসেবে পরিচিত, যা লৌকিক রাধাকৃষ্ণের ধর্মীয় প্রথা হিসেবে বাংলায় প্রচলিত। এটি কান্তজির মন্দির নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। শহর থেকে অনেকটা ভেতরে দুই ধারে গাছপালাবেষ্টিত সরু রাস্তা পার হয়ে যখন কান্তজির মন্দিরে যাবেন আপনি নিজের ভেতরে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি অনুভব করবেন।
কান্তনগর নামে পরিচিতি এই এলাকার কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে নদী, গাছপালা, সাঁওতাল ও শহুরে মানুষের মিশ্রণে এখানে গড়ে উঠেছে ভিন্নমাত্রার পরিবেশ। মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু করেন মহারাজ প্রাণনাথ রায় ১৭০৪ সালে যদিও নির্মাণকাজ শেষ করেন তাঁর পোষ্যপুত্র রামনাথ রায়। টানা ৪৮ বছর কাজ করে চলার পর ১৭৫২ সালে এটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। শুরুতে মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট। ১৭৫২ সালে মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়। ১৮৯৭ সালে মন্দিরটি ভূমিকম্পের কবলে পড়লে এর চূড়াগুলো ভেঙে যায়। মহারাজা গিরিজানাথ মন্দিরের ব্যাপক সংস্কার করলেও মন্দিরের চূড়াগুলো আর সংস্কার করা হয়নি। মন্দিরের বাইরের দেয়ালজুড়ে পোড়ামাটির ফলকে লেখা রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী।
ওপরের দিকে তিন ধাপে উঠে গেছে মন্দিরটি। মন্দিরের চারদিকের সবগুলো খিলান দিয়েই ভেতরের দেবমূর্তি দেখা যায়। মন্দির প্রাঙ্গণ আয়তাকার হলেও, পাথরের ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো ৫০ ফুট উচ্চতার মন্দিরটি বর্গাকার। মন্দিরের ভিত্তিমূলের দৈর্ঘ্য ৬০ ফুট ৩ ইঞ্চি। ভূমি সমতল থেকে ভিত্তিভূমির উচ্চতা ৩ ফুট। মেঝেতে ওঠার জন্য দুই পাশে পাঁচধাপ বিশিষ্ট সিঁড়ি আছে। মন্দিরের ভবনের দেয়ালের দৈর্ঘ্য ৫২ ফুট এবং আয়তন ৩ হাজার ৬০০ ফুট। নিচতলার সব প্রবেশপথে বহু খাঁজযুক্ত খিলান রয়েছে। দুটি ইটের স্তম্ভ দিয়ে খিলানগুলো আলাদা করা হয়েছে, স্তম্ভ দুটো খুবই সুন্দর এবং সমৃদ্ধ অলংকরণযুক্ত। মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি ওপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দিরের নিচতলায় ২১টি এবং দ্বিতীয় তলায় ২৭টি দরজা-খিলান রয়েছে, তবে তৃতীয় তলায় রয়েছে মাত্র তিনটি করে। বেশ কয়েকটি ধাপ ও চূড়াবিশিষ্ট এই মন্দিরটির নির্মাণরীতি মধ্যযুগীয়।
তবে কান্তজির মন্দির বিখ্যাত মন্দিরের গায়ে এর অপরূপ টেরাকোটার কাজের জন্য। পুরো মন্দিরে প্রায় ১৫ হাজারের মতো টেরাকোটা টালি রয়েছে। আপনি মন্দিরের এপাশ-ওপাশ ঘুরে বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করবেন, এই টেরাকোটাগুলোর একটা সঙ্গে অন্যটার কোনো মিল নেই। বরং টেরাকোটার চিত্রগুলো একে একে বর্ণনা করছে একেক গল্প। এসব পোড়ামাটির ফলকে মধ্যযুগের শেষদিকে বাংলার সামাজিক জীবনের নানা কাহিনী বিবৃত রয়েছে, উৎকীর্ণ হয়েছে রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণের কাহিনীর অংশ। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এ চারটি শাস্ত্রীয় যুগের পৌরাণিক কাহিনীগুলো মন্দিরের চার দেয়ালে চিত্রায়িত। তাই বৈদিক চিত্রকাহিনী সংবলিত টেরাকোটায় আচ্ছাদিত মন্দিরটি দেখলে মনে হবে এ যেন চার খণ্ডে শিল্পখচিত এক পৌরাণিক মহাকাব্যের দৃশ্যমান উপস্থাপনা। এ মন্দিরের টেরাকোটা আপনাকে কখনো নিয়ে যাবে মধ্যযুগীয় বাংলায়, আবার কখনো উপস্থাপন করবে পৌরাণিক কাহিনী। একটা স্থাপত্য আপনার ভেতরে কতখানি প্রভাব ফেলতে পারে তা কান্তজির মন্দিরে না গেলে আপনি ধারণা করতে পারবেন না।
প্রতিবছর নভেম্বর মাসে কান্তজি মন্দির প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয় রাশ পূর্ণিমা মেলার। মাসব্যাপী এই মেলায় ভিড় জমান অসংখ্য দর্শনার্থী আর পুণ্যার্থী। রাশ পূর্ণিমা উপলক্ষে তখন দিনাজপুরের রাজবাড়ি থেকে কান্তজি বিগ্রহ নিয়ে আসা হয় মন্দিরে। সবকিছু মিলিয়ে তখন এই জায়গাটার গুরুত্ব যেন বহুগুণ বেড়ে যায়। ঐতিহাসিক বুকামন হ্যামিলটনের মতে, কান্তজিউ বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরতম মন্দির। এ মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
স্থাপত্য রীতি, গঠনবিন্যাস, শিল্পচাতুর্য মন্দিরটির সামগ্রিক দৃশ্যকে এতই মাধুর্যমণ্ডিত করে তুলেছে যে এর চেয়ে সুন্দর, নয়নাভিরাম মন্দির বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। এই ছুটিতে যদি উত্তরবঙ্গ যাওয়ার পরিকল্পনা করে থাকেন, তবে কান্তজি মন্দিরটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখে ফেলুন। যতটা সময় আপনি এই মন্দিরে কাটাবেন, তা নিতান্ত বৃথা যাবে না।