টাঙ্গুয়ায় স্বচ্ছ জলে অতিথি পাখির মেলা
টাঙ্গুয়া ঘুরতে পারেন বর্ষা কিংবা শীতে। শীত আর বর্ষা—এ দুই ঋতুতেই মূলত টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরে মজা পাবেন।
শীতের টাঙ্গুয়া অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে। দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওরের এক বিল থেকে অন্য বিলে, এক হাওর থেকে অন্য হাওরে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে অতিথি পাখি। শীত উপেক্ষা করে অতিথি পাখি দেখতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসছেন পাখিপ্রেমিক ও পর্যটকরা। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে প্রচণ্ড ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে নেপাল, চীন, মঙ্গোলিয়া, সাইবেরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে টাঙ্গুয়ার হাওরে আসে অতিথি পাখি। লেনজা, মৌলভী, বালিহাঁস, সরালি, কাইম, কলাকুড়াসহ শতাধিক প্রজাতির লাখ লাখ অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর হয় টাঙ্গুয়ার হাওর। এ হাওরে প্রায় ৫১ প্রজাতির পাখি বিচরণ করে। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস, ঈগল, বড় আকারের গ্রে-কিংস্টক আসে এই হাওরে। স্থানীয় জাতের মধ্যে শকুন, পানকৌড়ি, কালেন, বৈদর, ঢাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস, কাক, শঙ্খচিল। এ ছাড়া আছে বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। এ ছাড়া ছয় প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণী, চার প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির উভচর, ছয় প্রজাতির কচ্ছপ, সাত প্রজাতির গিরগিটিসহ বিভিন্ন রকমের প্রাণীর বাস। এসব পাখি হাওরের জীববৈচিত্র্যকে করেছে ভরপুর।
বর্ষায় আপনি টাঙ্গুয়া দেখতে এলে দেখবেন রূপ আর যৌবনে পরিপূর্ণ এক ব্যতিক্রমী টাঙ্গুয়া। ছোটবেলায় পড়া সেই কবিতার ছবির মতো গ্রাম। শীতে অতিথি পাখির মেলা আর বর্ষায় দেখবেন পানির খেলা। শুধু পানি আর পানি। সে যেন এক মহাসমুদ্র! সত্যিই আপনি নিজে চোখে না দেখলে তা উপলব্ধি করতে পারবেন না।
বর্ষায় টাঙ্গুয়ায় নীল আকাশ পানির সঙ্গে খেলা করে। সাদা মেঘ যেখানে পাহাড়ের কোলে ঘুমায়। গাছের সারি যেখানে প্রতিনিয়ত সবুজ পানিতে গোসল করে। আর পানির নিচে যেন রঙিন বনের বসতি। তাড়াহুড়ো করে চাঁদ এসে জলের আয়নায় তার রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে থমকে দাঁড়ায়। ঢেউয়ের কোলে দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়ে তারার সারি।
বর্ষা মৌসুমে গোটা টাঙ্গুয়ার পরিণত হয় ২০-২৫ ফুট জলের এক স্বচ্ছ অ্যাকুরিয়ামে। হঠাৎ করে কেউ দেখলে নির্দ্বিধায় বঙ্গোপসাগর ভেবে ভুল করবে। এই সেই টাঙ্গুয়ার হাওর, যেখানে জল আকাশের রং চুরি করে নীলের ভুবন সাজিয়েছে। মেঘমালা অনেক নিচ দিয়ে উড়ে যায়, দূর থেকে দেখে মনে হবে পানিতে বুঝি তুলার ভেলা ভাসছে। সীমাহীন এই হাওরে বর্ষাকালে চলে বিশাল ঢেউয়ের রাজত্ব। পানি এতই পরিষ্কার যে ২০ ফুট নিচের ঘাস, গাছ, লতাগুলো মনে হয় অ্যাকুরিয়ামে সাজানো। অচেনা এক পৃথিবী মনে হয়, যখন থৈথৈ পানিতে ভাসছে ছোট ছোট গ্রাম।
পুরো হাওর গাছের সীমানা দিয়ে ঘেরা। সেই গাছও মাথাটুকু বাদে ডুবে আছে নীলের সমুদ্রে। এখানে বাতাস কখনো ক্লান্ত হয় না, এখানে আকাশের নিচে সাদা মেঘের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে কচি পাহাড়। আর সেই পাহাড়ের কোলে নাচে উদ্দাম, উত্তাল, দুরন্ত সবুজ জ্যাকেট পরা নীল পানি, হাওরের পানি।
১৯৯৯ সালে পরিবেশ-প্রতিবেশগত দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে বিশেষ সরকারি ব্যবস্থাপনার অধীনে আনা হয় টাঙ্গুয়ার হাওরকে। উদ্দেশ্য, এখানকার প্রাণীবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, হাওরপাড়ের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন। ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি এটি লাভ করে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইটের মর্যাদা।
যাতায়াত আর আবাসনের সমস্যা না থাকলে এই হাওর দেশের সবচেয়ে বড় পর্যটন স্পট হতে পারত। হাওরে আসা অতিথি পাখির ওপর অত্যাচার কমাতে সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন। সঙ্গে দরকার জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
যে পথে যাবেন
বর্ষায় গেলে সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে সাহেববাজার ঘাট পর্যন্ত রিকশায়। সেখান থেকে টাঙ্গুয়া হাওরের উদ্দেশে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করবেন। প্রতিদিনের জন্য ভাড়া নেবে তিন হাজার টাকা। হাওরে যেতে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। ভ্রমণটা বেশ উপভোগ্য। দুই-তিন দিনের জন্য নৌকা ভাড়া করলে প্রয়োজনীয় বাজার-সদাই করে নেবেন।
শীতকালে নৌকা চলবে না। সে ক্ষেত্রে আপনাকে সুনামগঞ্জ শহর থেকে সুরমা নদী ওপর নির্মিত নতুন ব্রিজ ধরে যেতে হবে তাহিরপুরের পথে। মোটরসাইকেলে যেতে পারেন, সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনও পাবেন। শ্রীপুর বাজার অথবা ডাম্পের বাজার হয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে পারবেন।
হাওর ঘুরে রাতটা তাহিরপুর থানার ডাকবাংলোতে কাটাতে পারেন। তাহিরপুরে রাত কাটালে পরদিন টেকেরহাট, বারিক্কাটিলাসহ জাদুকাটা নদী ঘুরে সুনামগঞ্জ চলে আসতে পারেন।
সড়কপথে সুনামগঞ্জ শহর থেকে তাহিরপুর পর্যন্ত মোটরসাইকেলপ্রতি ৩০০-৩৫০ টাকা ভাড়া গুনতে হবে। সঙ্গে নৌকার ধরন অনুযায়ী নৌকা ভাড়া এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে হবে।
একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, হাওরে নির্জন এলাকায় সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন। সঙ্গে খরচের বিষয়টি নিয়েও মাঝেমধ্যে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে পারেন। এ জন্য আগেই কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন।