ঘোরাঘুরি
গোল তালাবের সন্ধানে
নগরে যাঁরা থাকেন, তাঁদের অবসর কম। তাঁরা যদি নগরের ভেতরেই ঘোরাঘুরির সুযোগ পান, তাহলে কিন্তু খারাপ না। তাই ঢাকায় যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা ছুটির দিনে বেরিয়ে আসতে পারেন ঐতিহ্যমণ্ডিত পুরান ঢাকায়।
পুরনো ঢাকার অনেক পুরনো স্থাপনাই আপনারা দেখেছেন, কিন্তু প্রাচীন পুকুরটি কি দেখেছেন? বলছি পুরান ঢাকার আটসাট জনপদে বিশাল এক পুকুরের কথা। ইসলামপুরে অবস্থিত গোল তালাব বা নবাববাড়ির পুকুর এটি। প্রায় দেড় একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত এ পুকুরটি টিকে থাকা এখনকার সময়ে বিস্ময়করই বটে।
পুকুরটি খুঁজে পাওয়ার গল্পটা মজার। গুগল ম্যাপে ইসলামপুরের কাছে একটি পুকুরের দেখা পেলাম। কয়েকজন পুরান ঢাকাবাসীর কাছে জিজ্ঞেস করাতে তাঁরা জানান এটি বংশালে। আমার মন ভরে না, কারণ ম্যাপে দেখাচ্ছে ইসলামপুর। যাই হোক এক বিকেলে নিজে চলে গেলাম ইসলামপুরে। ম্যাপ ধরে অলিগলি গলি ঘেটে একদম কাছে চলে গেলাম। তবু কেউ হদিস দিতে পারল না। শেষে স্থানীয় এক মুরুব্বি পথের দিশা দিলেন। জানালেন, ইসলামপুর চায়না মার্কেটের সামনে দিয়ে চলে যেতে। তাঁর নির্দেশিত পথে চায়না মার্কেট পার হয়ে ডানে মোড় নিতেই আশ্চর্য সুন্দর পুকুরটির পাড়ে পৌঁছালাম। পুকুরটির বিশালতা আর তার ছায়াশোভিত পাড় শুরুতেই মন কেড়ে নিল।
প্রথমে শানবাঁধানো ঘাটে গিয়ে পা ভিজিয়ে নিলাম। এরপর সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসলাম আয়েশ করে। পুকুরটির আকার গোলাকার। চারপাশে বাঁধানো রাস্তা আর নারকেল গাছ। অন্তত ৫০টি নারিকেল গাছ প্রায় একই আকারের। পুকুরসংলগ্ন এসব গাছ পুরো এলাকাটিকে শীতল করে রেখেছে। ঘাটে মানুষজন গোসল করছে। আর ঘাটের ওপরে আলাদা গোসলখানায় সাবান দিচ্ছে, কারণ পুকুরে সাবান দেওয়া নিষেধ। গোসল করতে জনপ্রতি নেওয়া হয় পাঁচ টাকা।
পুকুর দেখা তো হলো, এবার এর ইতিহাস খোঁজার পালা। স্থানীয় দু-চারজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তেমন কিছু বলতে পারল না। একজন জানাল, আদিতে এটি পুকুর ছিল না, ছিল নবাবদের হাতি রাখার জায়গা। পরে পুকুর খনন করা হয়। তবে একজন মুরুব্বির কাছে পেলাম প্রকৃত তথ্য। তিনি জানালেন, পুকুরটি ১৮৩৮ সালে খনন করানো হয় আহসান মঞ্জিল পরিবারের নওয়াব আবদুল বারীর নির্দেশে। যেহেতু পুকুরটির আকার গোল তাই, একে গোল তালাব নামে ডাকা হতো। তালাব উর্দু শব্দ, যার অর্থ জলাধার। পরে এটি নবাববাড়ির পুকুর নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিতি পায়। আর সরকারি গেজেটে এর নাম ইসলামপুরের গোল তালাব।
কথা বলি পুকুরঘাটে বসে থেকে গোসলের অর্থ আদায় করা রেহান বারী নামে এক যুবকের সঙ্গে। তিনি বলেন, এটি বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে মৌলভি খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে।
আর এর সদস্যরা বেশির ভাগই নবাব পরিবারের বা তাঁদের আত্মীয়স্বজন। এই পুকুর ঘিরে রয়েছে এটি সমাজ ও পঞ্চায়েত। এ সমাজের সবাই একত্রিত হয়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন। এ পুকুরপাড়ে তাঁদের উদ্যোগে মেলা অনুষ্ঠিত হয়, হয় বড়শি দিয়ে মাছ ধরা প্রতিযোগিতা। বিকেল বেলা জমে ওঠে আড্ডা। পুকুর থেকে যে অর্থ আয় হয়, তা খরচ করা হয় পুকুরের উন্নয়নকাজে।
এলাকার দু-একজনের সঙ্গে কথায় কথায় জানতে পারি, এ পুকুর নিয়ে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। নবাবের বংশধর দাবি করে কয়েকজন এটি বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন। পরে আদালতের আদেশের কারণে তা আর পারেননি। ঐতিহ্যবাহী পুকুর হিসেবে সরকার সংরক্ষিত পুকুর ঘোষণা করেছে কিন্তু রাজউক ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এখনো কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি এখানে।
আপনিও একটা দিন সময় করে দেখে আসুন অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এ পুকুরটি। এর ছায়াঘেরা ঘাটে বসে প্রাণটা জুড়িয়ে আসুন।
কীভাবে যাবেন? পুকুরটি আহসান মঞ্জিলের ঠিক পেছনেই অবস্থিত। তবে যেতে হবে একটু ঘুরে। যে কোনো বাহনে ঢাকার ইসলামপুর চলে যাবেন। এরপর খুঁজে বের করবেন চায়না মার্কেট। এর ঠিক পাশেই পুকুরটির অবস্থান।