ঘুরে আসুন হাসন রাজার দেশ
‘লোকে বলে বলেরে, ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার
কী ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার
ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর
অয়না দিয়া চাইয় দেখি, পাকনা চুল আমার।’
পরিচিত গানের কথাগুলো মরমি সাধক কবি দেওয়ান হাসন রাজার। গানের এ কথাগুলোর সঙ্গে হাসন রাজার জীবনবোধ যে একেবারে মিলেমিশে একাকার। বেশ মিল রয়েছে তাঁর সর্বশেষ স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটির। যেখানে একটি জাদুঘরে সংরক্ষিত হচ্ছে তাঁর স্মৃতিচিহ্নগুলো। এখনো বাংলার লোকগানে ফিরে আসেন হাসন রাজা তাঁর লেখা অসাধারণ জীবনবোধের কবিতা ও গান নিয়ে। আজ থেকে বহু বছর আগে সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর ধারে প্রতাপশালী দাপুটে এ জমিদার বৈরাগ্য সাধনে মুক্তির পথ বেছে নিয়েছিলেন। প্রজাদের ওপর বিনা কারণে অত্যাচারী এবং ভোগবিলাসে মত্ত ছিলেন জমিদার হাসন রাজা। পরে এক আধ্যাত্মিক স্বপ্ন-দর্শন তাঁর জীবনকে আমূল পাল্টে দেয়। মন হয়ে ওঠে প্রসারিত, জীবন হয়ে ওঠে সহজ, সরল ও সাদাসিধে। বিলাসপ্রিয় জীবন ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাড়লেন জমকালো পোশাক। চরিত্রে এলো এক সৌম্যভাব; পরনে এলো সুফি পোশাক। জীবনের যত ভুলত্রুটি, শোধরাতে শুরু করলেন একে একে।
এতক্ষণে নিশ্চয় ভাবছেন, একদিন ঘুরে এলেই তো হয় হাসন রাজার বাড়ি। কেমন ছিলেন তিনি জানার প্রয়োজন। সাধারণ এক বাড়িতে সাধক এ রাজার যে স্মৃতিচিহ্ন এখনো অবশিষ্ট আছে, তা দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে সুনামগঞ্জ শহরের আরফিন নগরে। খুব সাদামাটা এক বাড়িতে সংরক্ষিত শেষ স্মৃতিচিহ্নগুলো নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি জাদুঘর, যা আপনাকে নিয়ে যাবে উনিশ শতকের শুরুর দিকের সেই সময়টাতে। ছোটখাটো কিন্তু সংরক্ষণের জন্য অনন্য সব জিনিস আপনাকে মুগ্ধ করবে নিশ্চিত। রাজার আয়েসি জীবন থেকে শুরু করে আপনি দেখতে পাবেন কবি জীবনের সব সংগ্রহ। বাদক যন্ত্র থেকে রাজার জমিদারি ম্যাপ—কী নেই সেই সংগ্রহে! আছে রাজার খড়মসহ ব্যবহার্য জিনিসপত্র। ঘরের এবং ঘরের বাইরের সব সংগ্রহের পাশাপাশি অবস্থান পেয়েছে বিশিষ্টজনের সঙ্গে রাজার সাক্ষাৎ ও দর্শনার্থীদের ভ্রমণের বিশেষ কিছু ছবি। এসব দেখতে দেখতে আপনি রাজার সেই আমলে ফিরে যাবেন; কল্পনার তুলিতে আঁকতে চাইবেন রাজার জীবন দর্শন। কীভাবে একজন রাজা একাধারে এত বড় রাজ্য শাসনের পাশাপাশি কবিতা ও গানের সঙ্গে নিজের জীবনবোধকে সাধনার রাজ্যে নিবিষ্ট করেছিলেন। কী ছিল তাঁর জীবন দর্শন?
এই মরমি সাধককে নিয়ে আজ দেশ-বিদেশে চলছে বিস্তর গবেষণা, তাঁর জীবনের বোধ কি এত সহজেই আবিষ্কার করা সম্ভব? না, তবে যেটুকু দেখে ফিরলেন তাতে হাসন রাজা সম্পর্কে জানার আগ্রহটা আরো বাড়িয়ে দেবে আপনার। সুনামগঞ্জের এই জাদুঘরের পাশাপাশি আপনি হাসন রাজা সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে অন্য একটা মিউজিয়ামও ঘুরে আসতে পারেন। সিলেট শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই মিউজিয়ামের নাম রাজা’স মিউজিয়াম। এটা শহরের জিন্দাবাজার এলাকায় অবস্থিত।
সুনামগঞ্জে এসেছেন আর কী দেখবেন? রাজার বাড়ি দেখার পর শহরটা ঘুরে দেখতে চাইলে বিকেলের শেষ দিকে আপনি ঘুরে আসতে পারেন অনিন্দ্য সুরমা নদীর ওপর নবনির্মিত আবদুজ জহুর সেতু থেকে। সুনামগঞ্জের যোগাযোগব্যবস্থার বিপ্লব বললেও ভুল হবে এই সেতুকে। সুরমা নদীর দুই পাড়ের জনপদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনকারী এই সেতুতে বিকেলের নিরিবিলি সময়টা কাটাতে পারলে আপনার অন্যতম একটি বিকেল হবে সেটি। বিশম্ভরপুর, তাহিরপুর আর জামালগঞ্জের সঙ্গে যোগ হওয়া এই সেতু থেকে পানিবেষ্টিত সুনামগঞ্জ শহর আর এর আশপাশের সবুজ প্রকৃতি আপনাকে বিমোহিত করবে।
এর পর সন্ধ্যার আগে আগে রিকশা নিয়ে চলে যান শত বছরের ঐতিহ্যবাহী সরকারি জুবিলী স্কুল দেখতে। অনেক জ্ঞানী-গুণীর বিদ্যাপীঠ এটি। জুবিলী স্কুলের পাশে রিভারভিউ পর্যটন কেন্দ্রটি আপনাকে দেবে অন্যরকম ভালোলাগা। সন্ধ্যার পর এখানে বসে কাটিয়ে দিতে পারেন কিছুটা সময়। বোনাস হিসেবে পাবেন দূরের পাহাড়ে মিটমিট আলো জ্বালানো ভারতের বেশ কিছু শহরের জেগে থাকার মনোরম দৃশ্য। নিশ্চিতভাবে আপনার ভ্রমণান্দ বাড়িয়ে দেবে অলস বসে থাকা এই সময়টা।
একদিনের জন্য সুনামগঞ্জ এলে এর বাইরে শহরের এদিক-সেদিক একটু ঘুরতেই আপনার দিন শেষ হবে। ভ্রমণ লম্বা করতে চাইলে দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান টাঙ্গুয়া দেখতে পারেন। দেখতে যেতে পারেন নারায়ণ তলা বর্ডার হাট। তবে হাট বসে মাত্র মঙ্গলবার। যেতে হলে লাগবে জেলা প্রশাসনের অনুমতি। টাঙ্গুয়া দেখতে শীত আর বর্ষা মৌসুম সবচেয়ে ভালো সময়। এর পাশাপাশি সময় থাকলে যাদুকাটা আর টেংরাটিলাও ঘোরা যেতে পারে। তবে সব কটি স্থানে যেতে আপনাকে ব্যয় করতে হবে বেশ সময়। সঙ্গে গুনতে হবে বেশকিছু খরচাপাতি। শহরের বাইরে যেখানেই যেতে চান, আপনাকে সময় জেনে আসতে হবে। তবে পানি ঘেরা সবুজে আচ্ছাদিত সুনামগঞ্জ শহর ঘুরতে চাইলে সময়ের বাধা নেই। তবে বর্ষা মৌসুমে সুনামগঞ্জ গেলে আপনি বোনাস হিসেবে পাবেন যাওয়ার পথে দুই পাশে পানিবেষ্টিত গ্রাম আর মাতাল হাওয়ার মতো ঢলানো স্মৃতি। যেতে যেতেই আপনার কাছে অনেকটাই আবিষ্কৃত হয়ে যাবে এখানের সৌন্দর্য। দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার ক্লান্তিটা ঝেড়ে ফেলেই আপনি প্রবেশ করবেন ছোট ছোট দালানকোঠা আর জাঁকজমকহীন এ শহরে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে সুনামগঞ্জ যেতে হবে। মাঝপথে সিলেটে নেমে ক্লান্তি দূর আর খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতে পারেন রেস্তোরাঁসমৃদ্ধ সিলেট নগরীতে। এখান থেকে সুনামগঞ্জ যেতে বাস ও কার দুটোই পাবেন। বাসের জন্য যেতে হবে কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডে আর কারে চড়তে চাইলে শাহজালাল (রহ.) মাজার গেটের পাশ থেকে যেতে পারবেন সুনামগঞ্জ শহরে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত পরিবহন ব্যবহার করতে পারেন। রাস্তা বেশ ভালো। বাসে গেলে সময় লাগবে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা, আর কারে যেতে লাগবে এক ঘণ্টার কমবেশ। শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় নামিয়ে দিলে রিকশা কিংবা বিদ্যুৎ চালিত অটোরিকশা মিলবে সহজেই। শহরের অন্য যেকোনো জায়গায় যেতেও মিলবে এসব যানবাহন।
খরচাপাতি
ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ চেয়ারকোচে ভাড়া পড়বে ৬০০-৭০০ টাকা। আর সিলেট পর্যন্ত ৪০০-৫০০ টাকা। সিলেটের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিজনের বাস (বিরতিহীন) ভাড়া একশ টাকা। কারে যেতে হলে আপনাকে গুনতে হবে দ্বিগুণ কিংবা সময়ভেদে তিন গুণ টাকা। বাসে যেতে হলে টিকেট করে উঠতে হবে। না হয় লোকাল বাসে চড়ে অযথা ভ্রমণটা ক্লান্তিতে ভরে উঠবে। সময় লাগবে বেশি; সঙ্গে ঝক্কি-ঝামেলা। তবে লোকাল বাসে কমতি ভাড়ায় ৬০ টাকা দিয়ে সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে পারবেন। শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় নেমে ভাড়া চুকিয়ে রিকশা কিংবা বিদ্যুৎ চালিত অটোরিকশা নিতে পারেন। হাসন রাজার বাড়ি যেতে বিদ্যুৎ চালিত অটোরিকশায় জনপ্রতি খরচ পড়বে ২০ টাকা। আর রিজার্ভ গেলে ভাড়া চুকিয়ে নেওয়াটা ভালো।
থাকা-খাওয়া
সার্কিট হাউস বা সরকারি ডাকবাংলোর পাশাপাশি আপনি থাকার জন্য হোটেল পাবেন বটে, তবে রাজার দেশে নেই কোনো রাজকীয় হোটেল-মোটেল! দেখেশুনে থাকতে পারবেন। তবে আয়েশ করে থাকাটা হবে না। তাই বলে একেবারে বাসের অযোগ্য নয়। ছোট-বড় হোটেলে দিন কয়েক অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারবেন। তেমন অসুবিধা হবে না। খাবারের জন্য আছে নদীর পাড়ে মাছে ভরা খাবারের দোকান। চাইলে তাজা মাছের স্বাদ পাবেন এখানে। থাকা আর খাওয়ার জন্য দামি হোটেল না থাকলেও বিলাসহীন পরিশুদ্ধ সব আতিথেয়তা আপনাকে মুগ্ধ করবে।