রিও’র ডায়েরি
অলিম্পিকের অবাক ময়দানে
সেদিন তো লেডিস কম্পার্টমেন্টে দাঁড়িয়ে থাকার ভুল করেছিলাম। যা হোক, পরে ভুল লাইন থেকে বের হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়ালাম। ট্রেনের পর বাস মিলিয়ে বাসায় আসতে অনেক রাত হয়ে গেল। আমি যে বাসায় উঠেছিলাম, সে বাসায় আমার রুমে থাকার ব্যবস্থা ছিল দুজনের। দেশে সেমি ডাবল বলে যেটাকে। একজন আরামে থাকা যায়, দুজন হলে একটু কষ্ট করে থাকতে হয়। আমি আরামপ্রিয় মানুষ, দুজনের ঝামেলায় যাইনি। সেদিন রাতেই খবর পেলাম, মালয়েশিয়ান একটা ফ্রেন্ড আসবে, কিন্তু সে প্রথম তিন দিনের থাকার জায়গা পাচ্ছে না।
আমি বললাম, আমার এখানে উঠে পড়ো। পয়সার ব্যাপারে কথা বলতে একটু ইতস্তত বোধ করছিলাম। তাই বললাম, থাকো দুদিন। পয়সা দেওয়া লাগবে না। মনে মনে ভাবছিলাম, সেই হয়তো সাধবে। কিন্তু না, সে ফ্রি ফ্রি থাকার জায়গা পেয়ে গেল। আমিও বললাম যাক, মালয়েশিয়ানদের মধ্যে বাংলাদেশিদের একটা বদনাম আছে। সে হয়তো ব্যাপারটায় খুশি হবে। আর সে না এলে তো জায়গাটা ফাঁকাই পড়ে থাকত। আসুক। গল্প করা যাবে।
বাসায় ঢুকতে আবার সেই কুকুরের জ্বালা (প্রথম পর্ব দ্রষ্টব্য)। কুকুরের নাম জুলি। ‘জুলি’ বলে ডাক দিলে হাই ভোল্টেজে চেঁচামেচি বন্ধ করে। একটা সিস্টেম শিখে গেলাম। রুমে ঢুকেই ব্যাগ থেকে ইউনিফর্মের সবকিছু নামালাম। ফেসবুকে একটা ছবি আপলোড না দিলে কী যেন বাকি থেকে যায়।
পরের দিন সকালে ফেস টু ফেস ট্রেইনিংয়ে ভেন্যুতে যাওয়ার কথা। এত বড় অলিম্পিক পার্ক যে কোনদিক দিয়ে যাব আর বের হব, সেটার জন্যও ১০ বার ভাবতে হয়। যদি ভুল দিকে যাই কোনোভাবে, আবার হাঁটা লাগবে দুই কিলো। এক গেটে ট্রাই করলাম, যেটা একেবারে মাঝখানে। সেখানে আর্মি অফিসার আমাকে পর্তুগিজে বলল, গেট সামনে। হাতে ইশারায় বুঝে গেলাম। ইশারা হচ্ছে ইউনিভার্সাল ল্যাঙ্গুয়েজ। অনেক বড় লাইন। চেক করে করে ঢোকানো হচ্ছে। আমার ভ্যেনুর নাম রিও অলিম্পিক এরিনা।
এয়ারপোর্টের মতো সিকিউরিটি চেক করে ঢোকার পর দেখি, আমি চৌরাস্তার মোড়ে। কোনদিক যাবো জানি না। টিম লিডারকে ফোন দিব, কিন্তু ফোনে ব্যালান্স নেই। একটা কথা না বললেই নয়। এখানে ফোনকল বাংলাদেশি টাকায় ২০ টাকা মিনিট। তাই ফোনে কল দেওয়া এক ধরনের বিলাসিতা মনে হয় আমার কাছে এখানে।
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মেসেজ দিলাম। টিম লিডার বলল, তুমি সোজা হাঁটো, একটা মেটাল কালারের বিল্ডিং দেখতে পাবে। আমি ওটার সামনে। তখনই একটা মেয়ে দেখি আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ইংলিশ বলতে পারো? সে বলল, হ্যাঁ। কথা বলে জানলাম, আমরা একই টিমে। সে পেশায় ডেন্টিস্ট। এখন রিসার্চ করছে। দেশের টপ মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে আছে। কথায় কথায় জানলাম, ব্রাজিলের ২০ কোটি জনসংখ্যা থেকে প্রতিবছর তাঁর ডিপার্টমেন্টে ৪০ জন ভর্তি হয়। সে তাঁদের মধ্যে একজন! জিজ্ঞেস করলাম, ইংরেজি শিখলে কোত্থেকে? সে বলল সে ইউএসএ-তে ছিল দুই বছর ইন্টার্নশিপের জন্য। তাঁর কাছ থেকে ব্রাজিল সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম।
কথা বলতে বলতে দুজন ভুল রাস্তায় চলে গেলাম! সে আবার টিম লিডারকে ফোন দিল। নিজেদের ভাষায় কী কী বলল। প্রায় ৩০ মিনিট অলিম্পিক পার্কে হাঁটার পর ভেন্যু খুঁজে পেলাম। টিমের আরো কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। আমার টিমটা এ রকম— মানুষ টোটাল ১৬-২০ জন। পিক শিফটে ছয়জন থাকবে, অফ পিক শিফটে চারজন থাকলেও হবে। আর দিনে দুটা শিফট। ইচ্ছামতো পছন্দ করে নেওয়া যায়। ভেন্যু ঘুরে দেখানো হলো।
কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হলো। আমাদের কাজ হচ্ছে দুই রকমের। ভেতরে একটা টিম থাকবে, বাইরে দুটো। ভেতরের টিমের কাজ হচ্ছে কখন কোন অ্যাথলেট বা অলিম্পিক ফ্যামিলির লোক আসবে, এগুলো নিয়ে জানানো। আর বাইরের টিমের কাজ হচ্ছে অ্যাথলেট বাস কখন আসবে-যাবে, সেগুলোর হিসাব রাখা। মিডিয়া বা সিকিউরিটি বাসেরও হিসাব রাখা। আরেকটা টিমের কাজ হচ্ছে প্রিভিলেজড লোকদের পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা। কাজ নিয়ে আমি খুশি। বুঝে গেলাম সামনের দিনগুলো যাবে স্টারদের সঙ্গে সেলফিময়!
খুব বেশি কাজ ছিল না সেদিন। লাঞ্চে গেলাম। ডেন্টিস্ট আপা আমাকে খাবারের ব্যাপারে কথা বলতে সাহায্য করলেন। আমি তো আবার পর্ক খেতে পারব না, এ ব্যাপারেও সে বুঝিয়ে দিল। ভেন্যুর খাবার খুব মজা। সব ধরনের খাবার দেয়। ব্রাজিলিয়ান ডিশ। আমার খুব ভালো লাগে। বিনস হচ্ছে ব্রাজিলিয়ানদের মূল খাবার। আমরা যেমন ডাল খাই, ওরা খায় বিন। সঙ্গে সবজি-মাংস আর পাস্তা টাইপের আইটেম থাকে। এর শেষে ডেজার্ট। তারপর আইসক্রিম আর কফি। একবেলা ভেন্যুতে খেলে সারা দিন না খেলেও চলে। প্রথম দিন কাজ বুঝে বাসায় গেলাম। পরের দিন মিশন শুরু। মিশন অলিম্পিক ২০১৬! দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম অলিম্পিক গেমস। আমি রোমাঞ্চিত!