রিও'র ডায়েরি
লেখাগুলো পাভেলের জন্য
গতদিনের ট্রেইনিং খারাপ ছিল না। যদিও এটা খুব জরুরি জিনিস বলে মনে হয়নি আমার কাছে। আমাকে ৭০ পেজের একটা স্লাইডের প্রিন্টেড কপি দেওয়া হলো যেন আমি এগুলো সব পড়ে বুঝে নিই। পর্তুগিজ ছেলেটির বইটা সুন্দর ছিল, কিন্তু আমারটা একেবারে চোথা ধরনের প্রিন্ট। নিয়ে ভেবেছিলাম, বাসায় বসে পড়ে একেবারে অলিম্পিকের ওস্তাদ হয়ে যাব। নাহ। কাগজের লেখার সাথে আমার সম্পর্ক খুব ভালো জমে না, তাই পড়াও হয়ে ওঠেনি। সেগুলো এখনো আমার ব্যাগে বন্দি সময় কাটাচ্ছে।
অলিম্পিক পার্কে প্রথমদিন যাব কাজের জন্য, ব্যাপারটা ভাবতেই খুব ভালো লাগছিল। ঘুম থেকে উঠলাম সকালে অনেক আগে আগে। খুব একটা রুটিন হয়ে গিয়েছিল। ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে কুকুর চেক করার পরে বাকি কাজ করা। অনেক আগেই রেডি হয়ে ফুরফুরে মেজাজে চলে গেলাম ভ্যেনুতে। এবার আর খুঁজে পেতে কোনো কষ্ট হলো না। আমার আবার বিশেষ এক সমস্যা আছে। আমি মানুষের চেহারা মনে রাখতে পারি না। লাইনে আমার কয়েকজন সামনে এক মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার দিকে তাকাচ্ছিল। চেনা চেনা লাগছে। আইডি কার্ডের দিকে তাকিয়ে দেখি হিজাব পরা একজন। চেকইনের আগে তাকিয়ে দেখি সে আগের দিনের পরিচিত ডেন্টিস্ট। তার সাথে গিজেল। ডেন্টিস্টের দাঁতে ব্রেস পরানো, এই দেখে চিনলাম। তার সাথে ছিল গিজেল। গিজেলের এটাই প্রথম দিন। সে কিছু চেনে না। আমি একটু ভাব নিয়ে বললাম, কোথায় যাবে? সে বলল, জানি না। টিম লিডার কল রিসিভ করছে না। তার কার্ডের পাসের দিকে তাকিয়ে দেখি আমাদের ভ্যেনুতেই। ট্রান্সপোর্ট টিমে। আমি বললাম, চলো আমাদের সাথে, চেকইন সেরে নিই।
কাউন্টারে গিয়ে চেকইন সারলাম। একটা ট্যাগ দেওয়া হলো যাতে লেখা I Speak English। যেন আমার মতো পর্তুগিজ না জানা লোকেরা কথা বলতে পারে। তার সাথে উপহার। দেওয়া হলো মহা মূল্যবান অলিম্পিকের ঘড়ি, তাও আবার সুইস-মেড! জীবনে প্রথম এমন কোনো ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরলাম। ওইদিকে দেখি গিজেল গায়েব। আমরা ভ্যেনুর সামনে যেতেই দেখি সে এক গাড়ি থেকে হাই দিল। মানে, তার কাজ হচ্ছে অলিম্পিক ফ্যামিলির ট্রান্সপোর্টেশনের সাথে। আমার কাজের জায়গায় গিয়ে দুই বয়স্ক ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয় হলো। একজন জার্মান স্টাডিজের প্রফেসর। আরেকজন কার্ডিওলজিস্ট, তিনি মেডিক্যাল টিমে কাজ করতে পারতেন,তবে ডিফরেন্ট কিছু করার আগ্রহে কাজ করছেন জেনারেল ভলান্টিয়ার হিসেবে। আর ডেন্টিস্ট তো আছেই। মার্সেলো আছে, সে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। আর টিম লিডার যে, তার কথা না বললেই না। দেখলে মনে হয় আমাদের বয়সী হবে। কিন্তু পরে কথা বলে জানলাম তিনি অস্ট্রেলিয়াতেই থেকেছেন পাঁচ বছর। আর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছেন ২০০৩ সালে। মনে মনে তাজ্জব বনে গেলাম।
টিমে আরেক ইতালিয়ান মেয়ে এসে পরে যোগ দিল এক সপ্তাহ পরে। প্রথমদিন গিয়ে কাজে কিছু বোর হচ্ছিলাম। গেমসের মোটামুটি অনেক সময় বাকি। শুধু খালি বাস আসে, খালি বাস যায়। নিয়ম আর কি। তেল পোড়ানোও নিয়মের আওতায় পড়ে বটে! বলাই বাহুল্য, তখন পর্যন্ত আমার টিমে টিম লিডার আর ডেন্টিস্ট ছাড়া আর কেউ ইংরেজি বলতে পারেন না। ডেন্টিস্টের কাছে শুনলাম সে পরেরদিন আসবে না। রিসার্চের কাজ আছে আর তার পেশেন্টের সাথে দেখা করা লাগবে।
দুপুরের লাঞ্চের পর ২ ঘণ্টা আগেই জানানো হলো আজ আর কাজ নেই। চলে যেতে পারি ইচ্ছে হলে। আমি খাবার আর ভেন্যুর কিছু ছবি আপলোড দিলাম। সেখানে অনেকে কমেন্ট করল। এক ফ্যামিলি ফ্রেন্ড আমাকে নক দিল। ওর সাথে আমার শুধু ফেসবুকেই লাইক আদান-প্রদান হয়। ওর পরিবারের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক মন্দ না। কথা বলতে বলতে সে বলল, পরে যদি কোথাও অ্যাপ্লাই করি, তখন যেন তাকে জানাই। একা একা যেন এসব না করি আর! আমি বললাম, ঠিক আছে জানাব। পরে বলল, ‘দেশে আস মিয়া। মাটির মানুষের সাথে দেখা না কইরাই পক্ষির মতো উড়াল দাও। এইটা কিন্তু ঠিক না।’ সে আবার গাড়ির ফ্রিক। আমি বললাম মালয়েশিয়া ঘুরে যাও। আর আমি নেক্সট দেশে এলে তোমার সাথে দেখা করব। সে বলল, এর পরে দেখি সেমিস্টার ব্রেক হলে আসতে পারি। আমি বললাম- আস, ঘুরে যাও। কিছু মজা না পেলেও ২০০ স্পিডে গাড়ি চালাইয়া মজা পাবা।
ওর সাথে কথা শেষ করেই দেখি আমাদের ভলান্টিয়ার গ্রুপে মেসেজ—কেউ রেকেরিও বিচে যাব নাকি। থিয়াগো সেখানে অপেক্ষা করছে। আমাকে বলল আমি যেন পারলে চলে আসি। আমি আবার ব্রাজিল আসার পর থেকেই বিচে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আরেকজনও অপেক্ষা করছিল, তবে সে ব্রাজিলে নয়, বাংলাদেশে বসেই। তার নাম হলো শুভ।
শুভ হলো আমার স্কুলের জুনিয়র। আদর করে তাকে ‘মোটা’ ডাকি। যখন ওকে ‘মোটা’ বলতাম তখন আমি শুকনা ছিলাম আর ও মোটা ছিল। এখন বিধি বাম। আমি মোটা শুভর চেয়েও মোটা হয়ে গেছি! কিন্তু গায়ের জোরে আমি এখনো ‘মোটা’ ডাকি। সে প্রতিদিন নক দেয়। ‘ভাই বিচে যাও’, ‘আমারে ছবি পাঠাও’, ‘বিচের ছবি দেখার খুব ইচ্ছা।’ ওকে প্রায়ই বলি শ্যামবাজার মোড়ে গিয়ে যেন বুড়িগঙ্গার বিচে বসে থাকে!
সব কিছু ভেবে ডিসিশন নিলাম যাব। রেকেরিও বিচ। রিওর একটা এভারেজ বিচ। আমার এখান থেকে উবার নিলাম। ডিরেক্ট ওখানে। থিয়াগোর সাথে দেখা। দেখে মনে হলো সে লেবানিজ হবে। কথা বলে ভালো লাগল। মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশি পেলে যে রকম ফিল হয় এখানে ইংলিশ স্পিকিং লোক দেখে সেই ফিল হয়। সে ব্রাজিল সম্পর্কে অনেক কিছু বলল। ব্রাজিলের ইকোনমি সাম্প্রতিক সময় ছাড়া সব সময়ই ভালো ছিল। আমিও ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলাম, এদের অবস্থা মালয়েশিয়া থেকে ভালো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে ধনী-গরিব বৈষম্য অনেক বেশি। কথা বলতে বলতে বিচের পাশের দোকান থেকে সে নিল একটা বিয়ার। আমি তো বিয়ার খাই না, তাই একটা ডাব নিলাম। বাংলাদেশি টাকায় ১৩০ টাকা পড়ল একটা ডাবের দাম। ট্যুরিস্ট পেলে নাকি ইচ্ছামতো দাম রাখে।
কথায় কথায় থিয়াগো জানাল, ব্রাজিলে নাকি এ রকম জায়গা আছে যেখানে লিভিং স্ট্যান্ডার্ড সুইডেনের মতো। আবারএর ঠিক এক কিলো দূরেই এমন জায়গা আছে যেখানে লিভিং স্ট্যান্ডার্ড আফ্রিকান গরিব কিছু দেশের চেয়েও থেকে হাজার গুণে খারাপ।
থিয়াগোকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ইংরেজি শিখলে কোথায়? উত্তরে বলল যে সে স্পেনে ছিল দুই বছর। তখন থেকেই স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ আর ইংরেজি শিখেছে। বুঝলাম যে সে শেখার ব্যাপারে অনেক প্যাশনেট। জিজ্ঞেস করলাম, পড়াশোনা কোথায় করেছ? সে জানাল, ইউনিভার্সিটি অব সাও পাওলোতে। আমি আবারো তাজ্জব বনে গেলাম, কারণ এই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির প্রতিযোগিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটুও কম নয়, বরং বেশিও হতে পারে! আমার একটা বাজে অভ্যাস হচ্ছে রাস্তা ঘাটের খাবার খাওয়া। অনেক বেশি স্ট্রিটফুড খাই। থিয়াগোর সহায়তায় অর্ডার করলাম। কড ফিশের ডামপ্লিং। মুখে নিয়ে দেখি অমৃত। খেতে খেতে অনেক গল্প হলো। দেখা হলো আমার ব্রাজিলের প্রথম বিচ। চলে আসলাম বাসায়।
*(মানুষের ভাগ্য-দুর্ভাগ্য বড় বিচিত্র। আমার যে পারিবারিক বন্ধুটির সঙ্গে কথা হয়েছিল, তার নাম আশিকুর রহমান পাভেল। আমি যখন এই পোস্টটা লেখা শুরু করব ভাবছিলাম তখন হোমপেজে নিউজ এলো, পাভেল আর নেই। এক সড়ক দুর্ঘটনায় সে মারা গেছে। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় এক শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে ওদের প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে পাভেল আর ওর তিন বন্ধুর করুণ মৃত্যু হয়েছে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এটাই ভাগ্য। মাটির মানুষের সাথে আর দেখা হলো না। মাটির মানুষের সাথে ২০০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালানোও হলো না। কোনোটাই না।
আল্লাহ এই বন্ধুটিকে উত্তম প্রতিদান দিক। আজ সকালে দুইটা খবর এলো আমার হোমপেজে। প্রথমটা হচ্ছে একটা জাতীয় দৈনিক আমার অলিম্পিক ট্যুর নিয়ে রিপোর্ট করেছে। এর ঠিক ঘণ্টাখানেক পর পাভেলকে নিয়েও রিপোর্ট হলো,সবই জাতীয় দৈনিকে এসেছে, তবে অন্যভাবে। আমি আমার অলিম্পিক ট্যুরের সব লেখা এই অকাল প্রয়াত বন্ধুটিকে উৎসর্গ করলাম। ভালো থেক পাভেল।)