আন্তর্জাতিক আদালতে আজ সু চির বক্তব্যের পালা
রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নিপীড়নের ঘটনায় জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত-আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিচারের শুনানির দ্বিতীয় দিনে আজ বুধবার বক্তব্য উপস্থাপন করবে বিবাদী মিয়ানমার। দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি আদালতে তাদের বক্তব্য তুলে ধরবেন আজ।
গতকাল মঙ্গলবার শুনানির প্রথম দিনে আদালতে বক্তব্য উপস্থাপন করেন গাম্বিয়ার পক্ষের আইনজীবীরা। তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ণ করতে রাষ্ট্রীয় মদদেই তাদের ওপর হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন চালানো হয়েছে। শুনানিতে, মিয়ানমারকে নিজ দেশের নাগরিক রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর চলমান গণহত্যা বন্ধ করতে অন্তর্বর্তী আদেশ জারির আর্জি জানিয়েছেন গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবুবকর তামবাদো।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছিলো মিয়ানমার। এর পর দুই বছর পেরিয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নিপীড়নের ঘটনায়, চলতি বছরের ১১ নভেম্বর গাম্বিয়ার করা মামলায়, গতকাল মঙ্গলবার নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরের পিস প্যালেসে স্থাপিত জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে বা আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছে।
গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদোর নেতৃত্বে বাদীপক্ষে উপস্থিত ছিলেন ওআইসির কূটনীতিকরাও।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের নেতৃত্বেও রয়েছে প্রতিনিধি দল। এ ছাড়া, নেদারল্যান্ডস ও কানাডার আইনজীবী এবং রোহিঙ্গা অধিকারকর্মীও রয়েছেন। মিয়ানমারের পক্ষে দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির নেতৃত্বে রয়েছেন কানাডার মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী উইলিয়াম সাবাস, অ্যাটর্নি জেনারেল তুন তুন ও দুইজন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা।
আইসিজের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুলকাওয়াই আহমদ ইউসুফ বলেন, ‘প্রথমদিন গাম্বিয়া তাদের বক্তব্য বলেছে। বুধবার মিয়ানমারের বক্তব্য শুনব। বৃহস্পতিবার গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের যুক্তি-তর্ক পর্ব হবে।’
প্রথম দিনের শুনানিতে, রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় অর্ন্তবর্তীকালীন কঠোর আদেশের প্রত্যাশা করেন গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল আবুবকর মারি তামবাদো। তিনি বলেন, বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ১০ লাখ রোহিঙ্গা। এ ছাড়া আরাকানে এখনো ৬ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, রাখাইনে গণহত্যার আলামত মিয়ানমার নষ্ট করেছে। তিনি উত্থাপন করেন রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনের তথ্যও।
আবুবকর মারি তামবাদো আরো বলেন, মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী রাখাইনে বসবাস করা রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, যৌন সহিংসতাসহ একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে এবং এখনো সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি জাতিসংঘের অনুসন্ধানকারী দলের তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শুনানিতে যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী তাফাদজ পাসিপান্দো বলেন, ‘রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণের কথা অস্বীকার করতে গিয়ে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি বলেছিলেন, নোংরা বাঙালি মেয়েদের বার্মিজ সেনা ও বৌদ্ধরা ছোঁবে না।’
শুনানিতে আরেক আইনজীবী অধ্যাপক পায়াম আখাভান বলেন, ফেসবুকে ‘ফেক রেপ’ নামে পেজ খুলেছিল স্টেট কাউন্সিলরের দপ্তর।
জাতিসংঘের তদন্তকারীরা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াতে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা ছিল। তাঁদের তদন্তে গণহারে হত্যা ও ধর্ষণকাণ্ড পরিচালনার প্রমাণ মিলেছে, যা জাতিসংঘের সনদের লঙ্ঘন।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতের ১৫ জন বিচারক টানা তিনদিন শুনানি শেষে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেবেন। ওই আদেশের পর তা বাস্তবায়ন প্রতিবেদন আগামী চারমাসের মধ্যে গাম্বিয়া ও মিয়ানমারকে দাখিল করতে হবে।
গত ১১ নভেম্বর রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনে মিয়ানমারের নামে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করেছিল গাম্বিয়া। ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে গাম্বিয়া এ মামলা করে। নিধনযজ্ঞ পেরিয়ে যাওয়ার প্রায় আড়াই বছর পর প্রথমবারের মতো কোনো দেশ এমন পদক্ষেপ নেয়।
রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে বিদ্রোহীদের হামলার জবাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আগস্টে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এক কঠোর বিদ্রোহ দমন অভিযান শুরু করে। এ সময় গণধর্ষণ, হত্যা ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়াসহ জাতিগত নির্মূল অভিযান থেকে বাঁচতে সাত লাখের অধিক রোহিঙ্গা পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত জাতিসংঘের অনুসন্ধানী দলের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত রাখাইনে ছয় লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। অত্যন্ত শোচনীয় পরিস্থিতিতে যাদের বসবাস করতে হচ্ছে।