ক্ষমতার পালাবদল নাকি আবারও ডোনাল্ড ট্রাম্প?
আবারও কি ডোনাল্ড ট্রাম্প, নাকি ক্ষমতার পালাবদল হতে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রে? সংবাদমাধ্যম আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে যখন ঘুম হারাম, ঠিক সে সময় প্রধান দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছুটছেন সুইং স্টেটগুলোর ভোটারদের মন গলাতে। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে আটটিতেই বেশি নজর দুই প্রধান রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টির। এর মধ্যে তিনটি অঙ্গরাজ্য শুধু পার্থক্যই গড়ে দেয় না; ইতিহাস বলছে, এখানে না জিতে কেউই প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। তাই শেষ মুহূর্তে বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন ঘনঘন যাচ্ছেন ওই অঙ্গরাজ্যগুলোতে।
আগামী ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বাকি আর মাত্র কয়েকটি দিন। তাই সারা বিশ্বের নজর যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। এরই মধ্যে সাত কোটির বেশি মানুষ আগাম ভোট দিয়েছে, যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে কিছু অদ্ভুত নিয়ম আছে। সব মিলিয়ে কয়েক লাখ পপুলার ভোট বেশি পেলেও সেই প্রার্থী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন, এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। কম পপুলার ভোট পেয়েও কোনো প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হতে পারে। আর এর কারণ হলো ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ ভোট। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে সেখানে নির্দিষ্টসংখ্যক ইলেকটোরাল ভোট থাকে। যে প্রার্থী পপুলার ভোটে জিতবেন, সেই অঙ্গরাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট তিনি পাবেন। আর এ জন্য আটটি সুইং স্টেটের দিকে নজর থাকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর।
তবে এবার নির্বাচনী সমীকরণ কিছুটা ভিন্ন হলেও তিনটি অঙ্গরাজ্য প্রার্থীর জয়-বিজয়ের পার্থক্য গড়ে দেবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। অঙ্গরাজ্য তিনটি হলো—পেনসিলভানিয়া (ইলেকটোরাল ভোট ২০টি), ফ্লোরিডা (ইলেকটোরাল ভোট ২৯টি) এবং ওহাইও (ইলেকটোরাল ভোট ১৮টি)। এই ৬৭টি ইলেকটোরাল ভোট এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
তিনটি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ওহাইও ছাড়াও আইওয়া, জর্জিয়া ও মিনেসোটাতে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন ট্রাম্প। তবে পেনসিলভানিয়া, মিশিগান, উইসকনসিন এবং ট্রাম্পের দুর্গ বলে পরিচিত টেক্সাসে জো বাইডেন এগিয়ে আছেন একাধিক জনমত জরিপে। আর এ কারণেই দুই প্রার্থীর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্লোরিডার ২৯টি ইলেকটোরাল ভোট। গত একশ বছরের বেশি সময়ে এই অঙ্গরাজ্যে না জিতে কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার জন্য ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেতে হয়। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছিলেন ৩০৪টি ইলেকটোরাল ভোট আর ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ক্লিনটন পেয়েছিলেন ২২৭টি। অথচ ট্রাম্পের চেয়ে ২৮ লাখ ৬৪ হাজার পপুলার ভোট বেশি পেয়েছিলেন হিলারি।
দুই মাস ধরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয় ও সংগঠনের জরিপে বেশ কয়েক পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছেন বারাক ওবামা সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী জো বাইডেন। ক্লিন ইমেজের এই প্রার্থীকে সমর্থন জানিয়েছেন প্রতিপক্ষ দলের অনেক হেভিওয়েট নেতাও।
অন্যদিকে, অনেকটা অস্বস্তিতে রয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চরম ব্যর্থতা, বর্ণবৈষম্য নিয়ে দেশজুড়ে উত্তাল আন্দোলন, বিনা কারণে কয়েকজন হেভিওয়েট মন্ত্রীকে একক সিদ্ধান্তে অব্যাহতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং আর্থিক মন্দার কারণে ট্রাম্পের ওপর ক্ষেপে আছেন ভোটাররা।
নানা অভিযোগ আর ব্যর্থতায় বিপর্যস্ত ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একটি লিফলেট প্রচার করছে বিরোধী দল। লিফলেটে দাবি করা হয়েছে—মার্কিন প্রেসিডেন্ট দীর্ঘদিন ধরেই করমর্দন পছন্দ করেন না। লিফলেটে আরো বলা হয়, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজার মামলা হয়েছে। তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার, ঠিকাদার, ক্লায়েন্ট ও কর্মীরা এ মামলা করেছেন। বেশ কয়েকটি ব্যাংকও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিল। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত ২৫ জন নারী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ এনে মামলা করেছেন।
ট্রাম্পের নিজের নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) ছিল, যা নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাটর্নি জেনারেল বন্ধ করে দেন বেআইনি কার্যকলাপের কারণে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ট্রাম্প এখন রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন; কিন্তু ২০০১ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেমোক্রেটিক দলের সদস্য হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন।
ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্প কখনো দেউলিয়া হননি। তবে তাঁর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আজ পর্যন্ত ছয়বার নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে ঋণের জাল কেটে বেরিয়ে এসেছে। একসময় এটাই ছিল ট্রাম্পের ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার ফন্দি।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের এই লিফলেট যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
গত নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন এমন ভবিষ্যদ্বাণী করার সাহস দেখাননি কেউই। কোনো জরিপেও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ধারেকাছেও ছিল না ট্রাম্পের নাম। তাঁর প্রতিপক্ষ হিলারি ক্লিনটন ছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং নারীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। কিন্তু ভোটের রাতে সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে জয়মাল্য গলায় পরেন বিশ্বখ্যাত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ট্রাম্প।
কোনো নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পছন্দ নয় আমেরিকানদের—এ বিষয়টি মাথায় রেখেই হিলারি ক্লিনটনকে এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন দৌড় থেকে দূরে রাখা হয় দলীয় হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে। বর্তমান প্রার্থী জো বাইডেন ক্লিন ইমেজের হওয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছে।
যুক্তরাষ্ট্রে মোট জনসংখ্যার ৭৬ দশমিক ৩ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ। এর একটি বড় অংশ বর্ণবাদী। মাত্র ১৩ ভাগ আফ্রিকান জনগোষ্ঠী বা কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে মূলত বৃহৎ শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ভোট পেতে চান ট্রাম্প। আর এই নির্বাচনী কৌশলে গত নির্বাচনে বাজিমাত করেছিলেন তিনি।
সাম্প্রতিক সব জরিপে ডেমোক্রেট দলের জো বাইডেন এগিয়ে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক দশকের ইতিহাসে সবচেয়ে ‘অজনপ্রিয়’ প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি আবারও চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হন, তাহলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।