তালেবানের ভয়ে ছবি-বই লুকিয়ে ফেলছেন শিল্পীরা : ওয়াশিংটন পোস্ট
আফগানিস্তানের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী তালেবানের পক্ষ থেকে এখনও শিল্পকলা ও সংস্কৃতিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা না হলেও, সশস্ত্র গোষ্ঠীটির দমন-পীড়নের ভয়ে নিজেদের চিত্রকর্ম ও বই লুকিয়ে রাখছেন দেশটির শিল্পী ও লেখকেরা। এমন তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।
প্রভাবশালী মার্কিন পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তালেবানের আগের শাসনামলের অভিজ্ঞতাকে স্মরণ করে ভয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন শিল্প ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। তাঁরা তালেবানের হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের সৃষ্টিগুলোকে লুকিয়ে ফেলছেন। সেইসঙ্গে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা তাঁদের কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছেন অন্য দেশেও।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ দুই দশকের উপস্থিতিতে দেশটির শিল্প ও সাংস্কৃতিক জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। সে সময় শিল্পীদের ওপর কোনো ধরনের ‘সেন্সরশিপ’ (বিধিনিষেধ) না থাকায় দেশটির শিল্প জগত ব্যাপকভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। নতুন প্রজন্মের এক ঝাঁক তরুণ তাঁদের শৈল্পিক সত্তার প্রকাশে উদ্যমী হন। কিন্তু, নতুন করে তালেবান ক্ষমতায় আসায় মারাত্মক অনিশ্চয়তা ও হুমকির মধ্যে পড়েছেন এসব শিল্পীরা। ফলে তাঁরা নিজেদের আঁকা ছবি, ভাস্কর্য, সংগীত দল, ব্যান্ড পার্টি, সিনেমা ও শিল্পকর্মগুলো লুকিয়ে ফেলছেন কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। কারণ, তালেবানের অধীনে কঠোর শরিয়া আইন জারি হলে এগুলোর জন্য তাঁদের শাস্তি পেতে হবে।
সাহারা করিমী নামের এক আফগান চলচ্চিত্র নির্মাতা বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি—শিল্পীদের স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনা প্রকাশ করার স্বাধীনতা থাকা উচিত। স্বৈরতন্ত্র বা সেন্সরশিপের অধীনে কোনো শিল্প-সংস্কৃতি টিকে থাকতে পারে না।’
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে দীর্ঘ দুই দশক শিল্প ও সংস্কৃতি জগত যে ধরনের অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে, তালেবান শাসন আমলের সঙ্গে তার তুলনা করে সাহারা করিমী আরও বলেন, ‘সে সময় শিল্পীরা বিনা বাধায় কাজ করতে পারতেন। তাঁরা সে সময় স্বাধীন ও স্বকীয় ছিলেন, এখনকার মতো নয়।’
কাবুলের চারুকলা ইন্সটিটিউটের পরিচালক সফিউল্লাহ হাবিবি বলেন, ‘তালেবান শিল্পকলা সংক্রান্ত কোনো বিবৃতি জারি করেনি। কিন্তু, শিল্পীরা নিজেরাই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছেন। তাঁরা মনে করছেন, তালেবান নব্বইয়ের দশকে যা করেছিল, তার পুনরাবৃত্তি করবে। তাদের সেই শাসনামলে আফগানিস্তানে শিল্পকলার কোনো স্থান ছিল না।’
এদিকে, তালেবানের সহকারী মুখপাত্র বিলাল করিমি বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিল্প ও সংস্কৃতি নিয়ে এখনও তাদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেনি। এ বিষয়ে একটি কাঠামো তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। যেখানে নির্ধারণ করে দেওয়া হবে—কোনটির অনুমোদন দেওয়া হবে, আর কোনটির নয়।’
তালেবানের সহকারী মুখপাত্র আরও বলেন, ‘ইসলামি আলেমেরা সিদ্ধান্ত জানাবেন—কোন ধরনের কাজের অনুমোদন দেওয়া যাবে, আর কোন ধরনের কাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে।’ যদিও চলচ্চিত্রের ভালো-মন্দ নিয়ে বিবৃতি দেওয়া ওই মুখপাত্রের চলচ্চিত্র সম্পর্কে কোনো বাস্তব জ্ঞান নেই।
এদিকে, সাধারণ আফগান জনগণ মনে করছে—তালেবান তার পূর্বের শাসনামলের দিকে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা চালাবে। যেহেতু পূর্বে তারা শিল্প-সংস্কৃতি এবং সব ধরনের বিনোদন মাধ্যমগুলো নিষিদ্ধ করেছিল, এবারও একই কাজ করবে তারা। এরই মধ্যে তাদের অঘোষিত নিয়ম লঙ্ঘনের দায়ে বেশ কয়েক জনকে শাস্তি পেতে হয়েছে। সেই সঙ্গে তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা এবং ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে, এটা অনুমেয় যে—তালেবান শিল্প ও সংস্কৃতি জগতে বড় ধরনের আঘাত হানতে যাচ্ছে।
নাইন-ইলেভেন হামলার পর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েক মাস আগে আফগানিস্তানে ইন্টারনেট নিষিদ্ধ করেছিল তালেবান। কিন্তু, এখন সেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে তারা টুইটারসহ অন্যান্য যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালায়। তালেবান কর্মকর্তারা টেলিভিশন ও রেডিওতে সাক্ষাৎকার দেন এবং হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্নের উত্তর দেন। এ ছাড়া কাবুলে তালেবান সৈন্যদের হাতে স্মার্টফোন দেখতে পাওয়া যায়। তাঁরা প্রকাশ্যে সেলফি তুলছেন এমন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ভাইরাল হয়েছে। ফলে, এই ইস্যুতে তালেবানের দ্বিচারিতার প্রমাণ মেলে বলে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
নবগঠিত তালেবানের অন্তবর্তীকালীন সরকার নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াসহ অন্যান্য কাজে ব্যস্ত। ফলে, শিল্প ও সংস্কৃতির বিষয়ে এখনও তারা আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। তবে, শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত রয়েছেন, তাঁরা আশঙ্কা করছেন—অচিরেই শরিয়া আইনের মাধ্যমে এই খাতে বিধিনিষেধ আরোপ করবে তালেবান শাসকগোষ্ঠী। তাই, অনেকেই দেশ ছেড়েছেন। যাঁরা ঝুঁকি নিয়ে এখনও দেশে রয়েছেন, তাঁরা তালেবানের চোখে খারাপ—এমন শিল্পকর্মগুলোকে হয় বিনষ্ট করছেন, অথবা লুকিয়ে রাখছেন। ফলে, আফগান শিল্প ও সংস্কৃতি জগৎ স্থবির হয়ে পড়েছে। এই অচলায়তন কবে ভাঙবে, তা কারোই জানা নেই।