ফিলিস্তিনিদের কি ভুলেই গেল আরব বিশ্ব?
এখন থেকে এক দশক আগেও যদি কোনো ইসরায়েলি সরকার পশ্চিম তীরের এক চিলতে জমি অধিগ্রহণের ঘোষণা দিত, আরব বিশ্বের ২২টি দেশেই প্রতিবাদের ঝড় উঠত। কিন্তু, গত জুন মাসে যখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পশ্চিম তীরের সবচেয়ে উর্বর অঞ্চল জর্ডান উপত্যকার বিশাল একটি অংশকে নিজ দেশের অংশ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, আরব দুনিয়ায় তেমন কোনো উচ্চবাচ্যই শোনা যায়নি। ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্তে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন একটি রাষ্ট্র তৈরির শেষ সম্ভাবনাও নস্যাৎ হয়ে যাবে—ফিলিস্তিনিরা বারবার এই আশঙ্কা প্রকাশ করলেও, সৌদি আরব এবং তার আরব মিত্ররা মৌনব্রত পালন করছে। তারপর দুই মাস না যেতেই দুটি উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন গত মঙ্গলবার (১৫ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে গিয়ে চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেদিনই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পাশে নিয়ে দাবি করেন, আরো অন্তত পাঁচটি আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
হতাশ ও ক্রুদ্ধ সাধারণ ফিলিস্তিনিরা দেখছে, গত অর্ধ শতাব্দী ধরে ইসরায়েলি দখলদারত্ব ঘুচিয়ে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রতি পুরো আরব বিশ্বের যে ঐক্যবদ্ধ সমর্থন, তাতে চিড় ধরতে শুরু করেছে।
ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা-সংগ্রাম এখন আরব বিশ্বের অনেক দেশে অগ্রাধিকারের তালিকায় ক্রমেই যে নিচে নামছে, তা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির বিশ্লেষকদের মধ্যে এখন আর তেমন কোনো সন্দেহ নেই।
সৌদি আরবের ইরান আতঙ্ক
আরব বসন্তের ধাক্কা, সিরিয়া-লিবিয়া-ইয়েমেন-ইরাকে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের হুমকি, তেলের দাম পড়ে যাওয়া—এসব কারণে অনেক আরব সরকার অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে এখন এতটাই ব্যস্ত যে ফিলিস্তিন ইস্যু তাদের কাছে এখন আর বড় কোনো এজেন্ডা নয়। সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে ইরান নিয়ে জুজু।
বিবিসির আরবি সংবাদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মনে করছেন, সৌদি আরব এবং আরো কিছু উপসাগরীয় দেশের মধ্যে ইরান-ভীতি এখন এতটাই প্রবল যে ইসরায়েলের সঙ্গের ঘনিষ্ঠতাকে তারা তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে দেখছে।
মোহাম্মদ ইয়াহিয়া বলেন, “ইরান এখন তাদের অভিন্ন শত্রু। ফলে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ১৮ বছর আগে ‘আরব ইনিশিয়েটিভ’ নামে যে সৌদি উদ্যোগ ইসরায়েলের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল, তা এখন অনেক দুর্বল।”
প্রয়াত সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহর উদ্যোগে ২০০২ সালে ২২টি আরব দেশ একযোগে ঘোষণা দেয়, যতক্ষণ না ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখল করা ফিলিস্তিনি জমি ছেড়ে দিয়ে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী মেনে নিয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করতে দিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না।
মোহাম্মদ ইয়াহিয়া বলেন, সৌদি আরব নিজেরাই তাদের সেই উদ্যোগকে দুর্বল করে দিয়েছে। এর প্রথম প্রকাশ্য ইঙ্গিত পাওয়া যায় ২০১৮ সালের এপ্রিলে যখন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে মার্কিন ইহুদি নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে খোলাখুলি ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের কড়া সমালোচনা করে বলেন, দাবি-দাওয়া নিয়ে তাদের নমনীয় হতে হবে।
ওই বৈঠক নিয়ে সেসময় বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিবেদনে লেখা হয়, যুবরাজ বিন সালমান খোলাখুলি বলেন, ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান সৌদি আরব চায়, কিন্তু ইরানের মোকাবিলা এখন তাদের কাছে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার।
মোহাম্মদ ইয়াহিয়া বলেন, ‘ইসলামী বিশ্বে নেতৃত্ব ধরে রাখার বিবেচনায় সৌদি আরব নিজে হয়তো এখন ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সময় নিচ্ছে, কিন্তু আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন-সৌদি আরবের অনুমোদন ছাড়া আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে এ চুক্তি করত না।’
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি এবং মুসলিম দুনিয়ার নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে আরব দেশগুলো এখন কয়েকটি গ্রুপে জোটবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যা ইসরায়েলকে তার রাজনৈতিক ইচ্ছে হাসিলে অনেক সুবিধা করে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সান-ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং পশ্চিম এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আহমেদ কুরু বলেন, আরব দেশগুলোর মধ্যে এখন যে বিভক্তি ও বিরোধ, তা সাম্প্রতিক ইতিহাসে আর দেখা যায়নি।
আহমেদ কুরু বলেন, ‘কয়েকটি ব্লকে তারা ভাগ হয়ে গেছে। একটি প্রভাব বলয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে রয়েছে আরব আমিরাত-ইরান,-ইরাক-সিরিয়া একদিকে, আবার কাতার যোগ দিয়েছে তুরস্কের সঙ্গে।’
ড. কুরু আরো বলেন, ‘এই বিভেদকে পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছে ইসরায়েল ... প্রায় বছর দশক ধরে আস্তে আস্তে ফিলিস্তিনি ইস্যু খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে।’
সেইসঙ্গে ইসরায়েলের পক্ষে হোয়াইট হাউসের বর্তমান প্রশাসনের পুরোপুরি একপেশে আচরণে ফিলিস্তিনিরা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। অভাব-অভিযোগ নিয়ে দ্বারস্থ হবে, আরব দুনিয়ায় ফিলিস্তিনের এমন মিত্রের সংখ্যা কমছে।
কিন্তু, ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব বিশ্বের সাধারণ জনগণের মনোভাব এখন কেমন? এ বিষয়ে লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউজের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক মোহাম্মদ এল-দাহশান বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে এক সময় ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব দেশগুলোর রাস্তায় যতটা আবেগ চোখে পড়ত, এখন ততটা নেই।
মোহাম্মদ এল-দাহশানের মতে এর একটি কারণ, আরব দেশগুলোর নতুন প্রজন্মের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের ইতিহাসের প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ফলে, তাদের বাবা-দাদাদের ফিলিস্তিন নিয়ে যতটা আবেগ আছে, তাদের মধ্যে ততটা নেই।
তবে মোহাম্মদ এল-দাহশান বলেন, ‘কিন্তু তাই বলে আবেগ পুরোপুরি চলে যাচ্ছে, তা কোনোভাবেই তা বলা যাবে না। আপনি যদি এখনো আমার জন্মস্থান মিসরে যান, দেখতে পাবেন ছোট একটি শহরে হয়তো স্থানীয় কোনো ইস্যুতে মানুষজন জড়ো হয়ে প্রতিবাদ করছে এবং তাদের কয়েকজনের হাতে ফিলিস্তিনি পতাকা। ওই জমায়েতের সঙ্গে ফিলিস্তিনের কোনো সম্পর্কই হয়তো নেই, কিন্তু তাদের হাতে আছে ফিলিস্তিনের পতাকা।’
মোহাম্মদ এল-দাহশান আরো বলেন, বেশির ভাগ আরব দেশে মানুষজন তাদের রাজনৈতিক মতামত দিতে পারে না। ফলে ফিলিস্তিনি ইস্যুতে তারা কী ভাবছে, তা একশোভাগ বোঝা সম্ভব নয়।
এ ছাড়া এল-দাহশান মনে করেন, যদিও একের পর এক আরব সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করছে, সে সম্পর্ক কতটা অর্থপূর্ণ হবে তা শেষ পর্যন্ত সেসব দেশের জনগণের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করবে।
মোহাম্মদ এল-দাহশান মিসর ও জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাসের উদাহরণ টেনে বলেন, গত কয়েক দশক ওই সম্পর্ক শুধু দুই সরকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।
মোহাম্মদ এল-দাহশান বলেন, ‘৪০ বছর আগে মিসর এবং ৩০ বছর আগে জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েলের একই ধরনের চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু এত দিনেও এই দুই দেশের মানুষের সঙ্গে ইসরায়েলের বা ইসরায়েলি জনগণের কোনো সম্পর্ক হয়নি।’
মোহাম্মদ এল-দাহশান আরো বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত বা বাহরাইনের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যদি ইসরায়েলের সম্পর্ক তৈরি না হয়, তাহলে তা শুধু দুই দেশের মধ্যে দূতাবাস স্থাপনের মধ্যেই সম্পর্কটা সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।’
এল-দাহশান মনে করেন, অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান এখনো গুরুত্বপূর্ণ।
তবে বিবিসি আরবি বিভাগের মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মনে করেন, ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সামনে এই মুহূর্তে বিকল্প খুব সামান্যই।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের গবেষক ওমর এইচ রহমান ওই প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক এক প্রকাশনায় লিখেছেন, এই পুরো পরিস্থিতির জন্য ফিলিস্তিনি নেতাদের দুর্বল নেতৃত্ব বহুলাংশে দায়ী।
গবেষক ওমর এইচ রহমান বলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন দুই বছর ধরে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নস্যাৎ করতে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন, তখন ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব বিকল্প কোনো প্রস্তাব-পরিকল্পনা হাজির না করে, বন্ধু তৈরির চেষ্টা না করে, পুরোনো বস্তাপচা স্লোগান দিয়ে চলেছে।’
গবেষক ওমর এইচ রহমান মনে করেন, মাহমুদ আব্বাস রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনে সবসময় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘শুভ বুদ্ধির উদয়ের’ জন্য অপেক্ষা করেছেন, এবং এর ফলে ধীরে ধীরে এখন অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন।
তাহলে কি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সম্ভাবনা চিরতরে শেষ হয়ে গেছে? এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ এল-দাহশান, যিনি নিজে জাতিসংঘে চাকরির সূত্রে দীর্ঘদিন পশ্চিম তীর এবং ইসরায়েলে ছিলেন, মনে করেন যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন ফিলিস্তিনিরাও বেশ কিছুদিন ধরেই আর দেখছেন না।
মোহাম্মদ এল-দাহশান বলেন, ‘পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে এখনো নতুন নতুন ইহুদি বসতি তৈরি হচ্ছে। ওই সব বসতিতে ইহুদি জনসংখ্যা আট লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ওই সব বসতি রক্ষার নামে ফিলিস্তিনি জনবসতির মধ্যে দেয়ালের পর দেয়াল উঠেছে। গাজা ভূখণ্ড এখন একটি কারাগার। ফলে ফিলিস্তিনিরা বুঝে গেছে রাষ্ট্র গঠন আর সম্ভব নয়।’
তাহলে ফিলিস্তিনিরা এখন কী করবে? এল-দাহশান বলেন, ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব এখনো মুখে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবি বাতিল করে দেননি। কিন্তু বিপুল সাধারণ ফিলিস্তিনি এখন মনে করছে যে তাদের সামনে এখন একটাই বিকল্প, আর তা হলো—নিজেদের রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাদ দিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্রে সমান অধিকারের দাবি তোলা।
মোহাম্মদ এল-দাহশান বলেন, ‘আমি মনে করি নেতারাও ভেতরে ভেতরে ভাবছেন, তাঁদের সামনে হয়তো আর কোনো বিকল্প রাস্তা নেই ... সুতরাং বল এখন ইসরায়েলের হাতে।’