ফ্রান্সে নির্বাচন : প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে কারা
ফ্রান্সের ভোটারেরা আগামী পাঁচ বছরের জন্য তাঁদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে এ মাসে ভোট দেবেন। এ নির্বাচন দুটো ধাপে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথম ধাপের ভোট হবে ১০ এপ্রিল। ওই রাউন্ডে ফলাফল নির্ধারণ না হলে দ্বিতীয় রাউন্ডের ভোট হবে ২৪ এপ্রিল। খবর বিবিসির।
প্রার্থী কারা?
ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ দ্বিতীয় মেয়াদে জয়ী হতে ভোটের লড়াইয়ে যোগ দিয়েছেন। ম্যাক্রোঁসহ নির্বাচনে মোট প্রার্থী ১২ জন। তাঁদের মধ্যে আট জন পুরুষ, চার জন নারী।
প্রধান ছয় প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে তিন জন ডানপন্থি এবং দুজন বামপন্থি ফরাসি রাজনীতিক।
এমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে দেখা হয় মধ্যপন্থি রাজনীতিক হিসেবে। তিনি ‘রিপাবলিক অন দ্য মুভ’ পার্টির প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাঁর প্রতি ডান ও বাম—উভয় শিবিরের ভোটারদের সমর্থন রয়েছে।
মারিন লা পেন ও এরিক জিম্যো দুজনেই অতি-ডানপন্থি। তাঁদের মধ্যে জিম্যোকে দেখা হয় সবচেয়ে বেশি কট্টরপন্থি হিসেবে। ভ্যালেরি পেক্রেস ডানপন্থি রিপাবলিকানদের প্রার্থী হয়েছেন। জ্যঁ-লুক মেলেশঁ নির্বাচন করছেন অতি-বামপন্থি রাজনৈতিক দল ফ্রান্স আনবাউড থেকে এবং ইয়ানিক জাদো গ্রিন পার্টি থেকে প্রার্থী হয়েছেন।
পর্যায়ক্রমে বেশ কিছু বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়ার পর ফ্রান্সের ঐতিহ্যবাহী বাম রাজনৈতিক দলগুলো এখন আর আলোচনায় নেই।
সোশালিস্ট পার্টির ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিন্তু, এর পর থেকে দলটির প্রতি সমর্থন কমে গেছে।
পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, বাম শিবিরের এ বিভাজনের কারণে এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ লাভবান হতে পারেন। যদিও ডানপন্থিরা অভিযোগ করছেন যে, ম্যাক্রোঁ তাঁদের নীতি অনুসরণ করছেন।
ইউক্রেনের যুদ্ধ নির্বাচনি প্রচারণায় বড় ধরনের জায়গা দখল করে নিয়েছে। তবে, ভোটারদের কাছে প্রধান ইস্যু—জীবন নির্বাহের খরচ বেড়ে যাওয়া।
ফরাসি নির্বাচনি ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে?
ধারণা করা হচ্ছে, দুই দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ১৪ দিনের ব্যবধানে।
যদি কোনো প্রার্থী প্রথম দফার নির্বাচনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পান, তাহলে যে দুজন প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন, তাঁরা পরবর্তী ধাপে অর্থাৎ দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচনে অংশ নেবেন।
প্রথম দফার নির্বাচনে কেউই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাবেন না বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রথম রাউন্ডের ভোট হবে ১০ এপ্রিল। আর, দ্বিতীয় রাউন্ডের ভোট ২৪ এপ্রিল।
দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে যিনি বিজয়ী হবেন, তিনিই ১৩ মে ফ্রান্সের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
জনমত জরিপ কী বলছে
ছয় মাস ধরে যেসব সমীক্ষা চালানো হচ্ছে, তাতে এগিয়ে রয়েছেন এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর ম্যাক্রোঁ আরও এগিয়ে যান। কিন্তু, পরে অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে তাঁর ব্যবধান কমতে থাকে।
বাকি প্রার্থীদের তুলনায় বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে রয়েছেন মারিন লা পেন। অন্যদিকে, অতি-ডানপন্থি এরিক জিম্যোর প্রতি সমর্থন কমে যেতে থাকে। কারণ, জিম্যো একবার বলেছিলেন—তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে শ্রদ্ধা করেন।
প্রধান নির্বাচনি ইস্যুগুলো কী
নির্বাচনি প্রচারণার প্রথম দিকে ইউক্রেনের যুদ্ধই প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এর ফলে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পায়।
তবে, সম্প্রতি যেসব জনমত সমীক্ষা চালানো হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে—মানুষের জীবিকা নির্বাহের খরচ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পরেই রয়েছে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, অবসর ভাতা, পরিবেশ ও অভিবাসন।
এ বছরের জানুয়ারিতে ফ্রান্সের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়, যা দেশটির গত অর্ধ-শতাব্দীর ইতিহাসে সর্বাধিক। এর মধ্যে কোভিড-১৯ মহামারি থেকে ফ্রান্সের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।
ফ্রান্সের অর্থনীতি বর্তমানে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতিতে সর্বস্তরের মানুষের ওপরে এর প্রভাব পড়েছে।
ফ্রান্সে বেকারত্বের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৭.৪ শতাংশে। ইউরোপ অঞ্চলের দেশগুলোর গড় হারের তুলনায় এ হার সামান্য বেশি। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ক্ষমতা গ্রহণের সময় যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, বর্তমান হার তার খুব কাছাকাছি।
এ ছাড়া অভিবাসনের বিষয়ে সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে—২০২০ সালে ফ্রান্সে বসবাসরত অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৬৮ লাখ। তাদের এক-তৃতীয়াংশ ইউরোপীয়, যারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য বা সদস্য নয়—এমন দেশগুলো থেকে ফ্রান্সে গেছেন। সবচেয়ে বেশি অভিবাসী গেছেন আলজেরিয়া থেকে। তার পরেই রয়েছে মরক্কো ও পর্তুগাল।
ডানপন্থি প্রার্থীদের নির্বাচনি প্রচারণায় অভিবাসনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। জিম্যো নির্বাচিত হলে ‘জিরো ইমিগ্রেশন’ নীতি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; অর্থাৎ তিনি একজন অভিবাসীকেও ফ্রান্সে আশ্রয় দেবেন না।
জিম্যো এও বলেছেন যে, প্রেসিডেন্ট হলে প্রতি বছর এক লাখ করে অভিবাসীকে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কোতে ফেরত পাঠানো হবে।
জিম্যোর এই দৃষ্টিভঙ্গির নিন্দা করেছেন মারিন লা পেন, তবে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে অভিবাসনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমানোর ব্যাপারে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছেন।
এ ছাড়া নিরাপত্তার ইস্যুতে ভ্যালেরি পেক্রেস, এরিক জিম্যো ও মারিন লা পেনের তীব্র সমালোচনার পর এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ আরও কয়েক হাজার পুলিশ মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ম্যাক্রোঁ দাবি করছেন, তাঁর আমলে অপরাধ কমেছে।
ফ্রান্সে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। যে কারণে অনেক ফরাসি ভোটারের কাছে নিরাপত্তার গুরুত্ব আরও বেশি জোরালো হয়ে উঠেছে।