সিঙ্গাপুরে করোনা ঠেকাতে যেভাবে চলছে গোয়েন্দা তৎপরতা
চীনের পর সবার আগে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়া দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর। যেখানে অন্যান্য দেশ করোনায় কাবু হয়ে পড়েছে, সেখানে ঘনবসতিপূর্ণ এই দ্বীপরাষ্ট্রটি বিভিন্ন কায়দায় এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে সন্দেহভাজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার সংস্পর্শে থাকা মানুষকে নজরদারির মাধ্যমে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে সিঙ্গাপুরের এমন গোয়েন্দা তৎপরতা সম্পর্কে জানানো হয়েছে। মূলত সিঙ্গাপুরে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে আসা মানুষের মাধ্যমেই ছড়ায় ভাইরাসটি।
ওষুধের দোকান থেকে সংক্রমণ
গত ৪ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুর সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, স্থানীয়ভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস। এর প্রথম সংক্রমণ পাওয়া যায় ইয়ং থাই হ্যাং নামে একই চীনা ওষুধের দোকানে। এর মধ্যে স্থানীয় একজন ট্যুর গাইড ও একজন বিক্রয়কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ওই ওষুধের দোকানটি থেকেই ৯ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়। এর মধ্যে বিক্রয়কর্মীর স্বামী, তাঁদের ছয় মাসের সন্তান এবং তাঁদের ইন্দোনেশিয়ান গৃহকর্মী ছিলেন। এ ছাড়া ওই দোকানের আরো দুজন কর্মীও আক্রান্ত হন। যদিও তাঁদের সবাই এখন সুস্থ আছেন।
তবে পরিস্থিতি আরো অনেক ভয়াবহ হতে পারত, যদি না দেশটিতে কন্টাক্ট ট্রেসিং বা সংস্পর্শের ইতিহাস নির্ণয় করার পদ্ধতি না থাকত। সেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের মধ্যে এ পদ্ধতি কাজে লাগিয়েই নিস্তার পেয়েছে সিঙ্গাপুর। এর মাধ্যমে ভাইরাসটি একজন থেকে কীভাবে আরেকজনের মধ্যে সংক্রমিত হয় তা নির্ণয় করা, ওই ব্যক্তিদের শনাক্ত করা এবং তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
মাউন্ট এলিজাবেথ নভেনা হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং সিঙ্গাপুর সরকারের উপদেষ্টা লেয়ং হো নাম বলেন, ‘আমাদের অবস্থাও উহানের মতো হয়ে যেতে পারত।’
এখন পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে ৩৮৫ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। গত ১৬ মার্চ পর্যন্ত সংক্রমিতদের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষের মধ্যে কোনো উপসর্গ পাওয়ার আগেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পরীক্ষা করতে এবং নিজেদের বিচ্ছিন্ন (আইসোলেট) করতে বলা হয়।
এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসার জন্য সিঙ্গাপুরে মোট ছয় হাজার ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সিসিটিভি ফুটেজ, পুলিশের তদন্ত ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে তাঁদের শনাক্ত করা হয়।
হঠাৎ একটি ফোন
এক শনিবার সিঙ্গাপুরভিত্তিক ব্রিটিশ যোগব্যায়ামের শিক্ষক মেলিসার (ছদ্মনাম) কাছে একটি ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে তাঁকে জানানো হয়, তিনি করোনা সংক্রমণের শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন।
মেলিসা বলেন, “আমাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কি বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৭ মিনিটে ট্যাক্সিতে ছিলেন? এরপর আমি কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে যাই। আমি ঠিকমতো চিন্তাও করতে পারছিলাম না।”
এরপর প্রশ্নকর্তাকে মেলিসা জানান, তিনি ওই ট্যাক্সিতে ছিলেন। এবং ট্যাক্সি অ্যাপে দেখেন যে ওই ট্যাক্সিতে তিনি মাত্র ছয় মিনিট ছিলেন।
মেলিসা বুঝতে পারছিলেন না যে ওই ট্যাক্সির চালক অথবা ট্যাক্সিতে আগে বসা অন্য কোনো যাত্রী করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কি না।
তিনি শুধু জানতেন, সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা তাঁকে ফোন করে ঘরে কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
এরপরই মেলিসা বুঝতে পারেন, কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে কতটা তৎপর। ফোন আসার পরদিনই জ্যাকেট ও সার্জিক্যাল মাস্ক পরা তিন ব্যক্তি তাঁর বাসায় আসেন।
মেলিসা বলেন, ‘এটা অনেকটা সিনেমার মতো লাগছিল। তাঁরা আমাকে একটি চুক্তিপত্র দিয়েছিল। চুক্তিপত্রে বলা হয়, আপনি আপনার বাসার বাইরে বের হতে পারবেন না, অন্যথায় জেল–জরিমানা হবে। সেটি একটি আইনি নোটিশ ছিল।’
এর দুই সপ্তাহ পর করোনাভাইরাসের কোনো লক্ষণ না থাকায় তাঁকে বাইরে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
সিঙ্গাপুর সবচেয়ে ঘনবসতি দেশগুলোর মধ্যে একটি। তাই সেখানে করোনায় সংক্রমণের আশঙ্কাও ছিল বেশি। এ জন্য করোনার ঝুঁকিতে থাকা প্রত্যেককেই শনাক্ত করে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
উত্তরের খোঁজে
কনসেসাও এডউইন ফিলিপ সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া করোনা আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করেন। তিনিসহ আরো তিনজন এ কাজটি করছেন।
হাসপাতালে আসা করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীরা কাদের সংস্পর্শে এসেছেন এবং কোথায় কোথায় গেছেন, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে ফিলিপের দল।
ফিলিপ বলেন, ‘আমরা যখন ব্যক্তির মধ্যে করোনা পজিটিভ পাই, তখন সব কাজ বাদ দিয়ে দিবাগত রাত ৩টা পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাই। পরদিন সকালে আবারও সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়।’
ওই তথ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করেন তাঁরা, এরপর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
এডউইন ফিলিপ বলেন, ‘প্রথম তথ্যটি না পাওয়া গেলে কোনো কিছুই মেলানো সম্ভব না। এটি অনেকটা ধাঁধার মতো। সবকিছুই আপনাকে মেলাতে হবে।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যেসব দল এমন কাজ করে থাকে, সে দলগুলোর একটিকে নেতৃত্ব দেন জুবাইদা সাইদ নামের একজন। তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জুবাইদার দলকে অনেক সমস্যার মুখে পড়তে হয়। কিছু রোগী এত অসুস্থ হয়ে পড়েন যে, তিনি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর্যায়ে থাকেন না। আর এ জন্য তাঁদের কাজটি আরো কঠিন হয়ে যায়।
এ জন্য তৈরি থাকে আরেকটি দল। এ ধরনের কাজের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সহায়তাও নেয় সিঙ্গাপুর।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার লিয়াম ঘিম হুয়া বিবিসিকে বলেন, ‘তথ্য আদান-প্রদানের জন্য পুলিশ ও মন্ত্রণালয় নিয়মিত টেলিকনফারেন্স করে।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৫০ জন কর্মকর্তা কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের জন্য কাজ করে। কোনো দিন ১০০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা কাজ এ কাজ করেন।’
এ কাজে তদন্ত বিভাগ মাদক বিভাগ ও গোয়েন্দা বিভাগেরও সহায়তা নিয়ে থাকে। সিসিটিভি ফুটেজ ও তদন্তের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে অচেনা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয়।
পার্থক্য গড়ে দিয়েছে সিঙ্গাপুরের পদ্ধতি
এদিকে সিঙ্গাপুর এমন পরিস্থিতিতে যেভাবে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, এর প্রশংসা করছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিষয়ক বিশেষজ্ঞরাও।
প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার আগেই যে সিঙ্গাপুর কন্টাক্ট ট্রেসিং শুরু করেছে, সে বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও দেশটির প্রশংসা করেছে।
নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সিওসি ওয়াইলস বলেন, ‘কন্টাক্ট ট্রেসিং করতে যদি আপনার দেরি হয়, তাহলে বিষয়টি অনেক দেরি হয়ে যায়। কারণ, তখন এটি অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু সিঙ্গাপুর যতটা নিখুঁতভাবে রোগী শনাক্ত করেছে, তা অনেক দেশের পক্ষেই করা সম্ভব হবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়, সিঙ্গাপুরের মতো নজরদারির ব্যবস্থা খুব বেশি দেশে নেই।
তবে এটি সম্ভব হয়েছে জনসাধারণের সহযোগিতামূলক মনোভাবের কারণে। সরকার থেকে ফোন করে যখন সহায়তা চাওয়া হয়, তখন সবাই সহায়তা করেছে।
সিঙ্গাপুরের সংক্রামক রোগ বিষয়ক আইন অনুযায়ী, পুলিশ তথ্য সংগ্রহ করতে চাইলে তাদের সহায়তা না করা বেআইনি। এ অপরাধের জন্য জরিমানা হিসেবে ১০ হাজার সিঙ্গাপুর ডলার বা ছয় মাসের জেল অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হতে পারে।