সুদানের সংঘাতে যে কারণে উদ্বিগ্ন প্রতিবেশী দেশগুলো
সংঘাত লেগেই আছে সুদানে। দেশটিতে তৈরি হয়েছে নতুন ধরনের সরকার ব্যবস্থা ও মানবিক সঙ্কট। এ কারণে তেল পাইপলাইন ও নীলনদের পানি ভাগাভাগি নিয়ে প্রতিবেশী দেশসহ অন্যান্য দেশগুলোতেও তৈরি হচ্ছে সমস্যার জট।
বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল সুদানে সংঘাত নতুন কোনো সমস্যা নয়। তবে, এবার লোহিত সাগরের তীরের এই ভূখণ্ডে সংঘাত দুর্গম এলাকাতে ছড়িয়ে না পড়ে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হচ্ছে রাজধানী খার্তুমে ও এর আশেপাশের এলাকায়।
সুদানের পাঁচটি প্রতিবেশী দেশ-ইথিওপিয়া, চাদ, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, লিবিয়া ও দক্ষিণ সুদান নিজেরাই গত কয়েক বছর থেকে রাজনৈতিক উত্থানপতন ও সংঘাতে জর্জরিত।
আল-জারিরা এসব তথ্য তুলে ধরার পাশাপশি বলছে, ২০১৯ সালে সুদানের শাসক ওমর আল-বাশিরকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকে দেশটিতে বেসামরিক শাসন ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তা প্রায় ভেস্তে যেতে বসেছে। সুদানের সেনাবাহিনী ও র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের (আএসএফ) মধ্যে এখন চলতে থাকা সশস্ত্র সংঘাতের কারণে।
এই সংঘাত চলছে সুদানের ক্ষমতাসীন কাউন্সিলের প্রধান ও সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল আবদেল আল-বুরহানের সঙ্গে এক সময়ের মিলিশিয়া নেতা মোহামেদ হামদান দাগালোর, যিনি হেমেদটি নামে বেশি পরিচিত। হেমেদটি ছিলেন বুরহানের ডেপুটি ও অনিয়মিত বাহিনী আরএসএফের নেতা।
সুদানের সংঘাত এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য যে বিপদ ডেকে আনছে…
মিশর : আরব দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে মিশরের ইতিহাস সুদানের সঙ্গে এক সুতোয় গাঁথা। দেশ দুটির রাজনীতি, বাণিজ্য, সংস্কৃতি এমনকি নীল নদের পানিও একঅন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া।
সামরিক সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি সুদানের আল-বুরহানের কাছের মানুষ। এ ছাড়া ৬০ হাজার শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীসহ প্রায় ৪০ লাখ সুদানি নাগরিক মিশরে অবস্থান করা সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিবাসী জনগোষ্ঠী।
মিশর ও সুদান দুটি দেশই সুপেয় পানির সরবরাহের জন্য নীল নদের ওপর নির্ভরশীল এবং উভয়েই উজানে ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ ড্যাম নির্মাণের কারণে হুমকির মুখে। দুটি দেশই ইথিওপিয়ান ড্যামের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত। তাই খার্তুম ও কায়রোর সম্পর্কের টানাপোড়েন এই ড্যাম সংক্রান্ত চুক্তিকেও প্রভাবিত করতে পারে।
লিবিয়া : ২০১১ সালের পর বিভক্ত লিবিয়ায় সুদানি ভাড়াটে সৈন্য ও মিলিশিয়ারা দুটি অংশেই যুদ্ধে জড়িত ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব ভাড়াটে সুদানি সৈন্যরা সুদানের পশ্চিমে দারফুরে ফিরে গেছে আর সেখানেও কয়েক বছর ধরে সংঘাত চলছে। লিবিয়া হয়ে ইউরোপের পথে চলা আশ্রয়প্রার্থীদের ট্রানজিট হিসেবে সুদানকে ব্যবহার করে মানব পাচারকারীরা। তাই সংঘাতের সুযোগকে বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে পাচারকারীরা।
চাদ : সংঘাতের কারণে সুদানের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশ চাদে পালিয়ে গেছে প্রায় চার লাখ বাস্তুচ্যুত সুদানি। আর সাম্প্রতিক সংঘাতে আরও প্রায় ২০ হাজার শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে সেখানে। এই তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘ।
চাদ শঙ্কিত হয়ে পড়েছে তার সীমান্ত এলাকা নিয়ে যেখানে সুদানি শরণার্থীরা অবস্থান নিয়েছে। জানজাওয়িদ নামে পরিচিত মিলিশিয়ারা এখানে বেশ সক্রিয় যারা এসেছে সমস্যাসঙ্কুল দারফুর থেকে। সুদানের আরএসএফের সঙ্গে একীভূত হওয়া বাহিনীটির সদস্যরা চাদের সীমান্তে দেশটির নাগরিকদের গবাদিপশু ছিনিয়ে নেয় ও বাধা দিলে মানষকে মেরে ফেলে এমন অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া চাদ প্রতিবেশী দেশ মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে সক্রিয় রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে সৈন্যদের বিষয়েও উদ্বিগ্ন। অভিযোগ আছে তাদের সঙ্গে সুদানের আরএসএফের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তবে, ওয়াগনার সুদানে তাদের তৎপরতার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে।
উপসাগরীয় আরব দেশগুলো : সুদানে আল-বাশিরের শাসনাবসানের পর ওই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও ইসলামি প্রভাব বাড়াতে বেশ তৎপর হয়ে ওঠে ধনী তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। লোহিত সাগরের তীরে কৃষি স্থাপনা থেকে শুরু করে বন্দর ও বিমান পরিবহণ ব্যবসায় রয়েছে দুটি দেশেরই প্রচুর বিনিয়োগ।
দক্ষিণ সুদান : কয়েক যুগের গৃহযুদ্ধের পর ২০১১ সালে সুদান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দক্ষিণ সুদান। দেশটি তার উত্তরের প্রতিবেশী দেশে প্রতিদিন ১ লাখ ৭০ হাজার ব্যারেল তেল রপ্তানি করে পাইপলাইনের মাধ্যমে। দেশ দুটির কোনোটিই চায় না তেল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটুক। তবে, দক্ষিণ সদান সরকার এ সপ্তাহে জানায় যে সংঘাতের কারণে পোর্ট সুদান ও তেলক্ষেত্রগুলোতে লজিস্টিক ও পরিবহণ ব্যবস্থায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এ ছাড়া প্রায় আট লাখ দক্ষিণ সুদানি শরণার্থী বাস করে সুদানে। তারা যদি এখন আবার দক্ষিণ সুদানে ফিরে আসে তবে আগে থেকে সেখানে থাকা প্রায় ২০ লাখ বাস্তুচ্যুত লোকজনের সহায়তা কার্যক্রমের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
ইথিওপিয়া : সুদানের সঙ্গে ইথিওপিয়ার সীমান্ত ঘেষা অঞ্চলে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। সুদানের অস্থির অবস্থার কারণে দুই দেশের সুযোগসন্ধানীরাই এখানে সুবিধা নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় টিগ্রে এলাকায় ২০২০ সালে যখন যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে তখন প্রায় ৫০ হাজার ইথিওপিয়ান শরণার্থী সুদানের পূর্বাঞ্চলে আশ্রয় নেয়।
এ ছাড়া ইথিওপিয়া তাদের চার বিলিয়ন ডলারের নীল নদ ড্যামের বিষয়েও চিন্তিত কেননা সুদান তাদের নিজস্ব ড্যাম ও জনগণের জন্য সেটিকে হুমকি মনে করছে।
ইরিত্রিয়া : ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টিগ্রে যুদ্ধের কারণে অনেক ইরিত্রিয়ান শরণার্থী ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চলে আশ্রয় নেয়। এ ছাড়া সুদানে থাকা ইরিত্রিয়ান শরণার্থীরা আবারও পালিয়ে অন্য জায়গায় যেতে পারে যদি সশস্ত্র সংঘর্ষ সুদানের রাজধানী খার্তুম থেকে অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
যে শঙ্কায় বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো…
রাশিয়া : সুদানে আল-বাশির ক্ষমতায় থাকতে রাশিয়া দেশটির সঙ্গে একটি চুক্তি করে রুশ নৌবাহিনীর জন্য সেখানকার উষ্ণ পানির বন্দর ব্যবহার করতে। সুদানের সামরিক নেতারা বলে আসছেন এই চুক্তি পর্যবেক্ষণে রয়েছে। ২০২০ সালে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সুদানে পারমাণবিক শক্তি চালিত জাহাজ নোঙর করার অনুমতিও দিয়েছিলেন।
২০২২ সালে খার্তুমে পশ্চিমা কূটনীতিকরা জানিয়েছিল যে রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপ সুদানে খনি থেকে অবৈধভাবে স্বর্ণ আহরণে জড়িত। দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র সুদানে সক্রিয় দুটি কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এই বলে যে সেগুলোর সঙ্গে ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভগানি প্রিগোঝিনের সম্পর্ক রয়েছে। তবে, গত বুধবার এক বিবৃতিতে ওয়াগনার জানায় সুদানে তাদের কোনো তৎপরতা নেই।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই লাভরভ আফ্রিকা সফরের সময় সুদানে মস্কোর প্রভাব বাড়ানোর ওপর জোর দেন যখন পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনে আগ্রাসনের কারণে রাশিয়াকে কোনঠাসা করতে ওঠেপড়ে লেগেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব : সুদানে আল-বাশিরের পতনকে ইতবাচক হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো। দারফুর সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বাশিরকে অভিযুক্ত করে।
তবে, সমালোচকরা বলছে সেখানে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে ওয়াশিংটন সময়ের পেছনে চলছিল। ২০২১ সালে আল-বুরহান ও হেমেদটি যখন সামরিক অভুত্থান ঘটায় তখন সুদানের নাগরিকরা আশায় বুক বেঁধেছিল যে, সেখানে গণতন্ত্র আসবে।
তবে, সুদান বেসামরিক শাসনে ফিরতে পারবে কিনা, এমন আশা ক্রমেই লক্ষ্যচ্যুত হচ্ছে। কেন না খার্তুমে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসানে বিবাদমান পক্ষগুলো আপোসের প্রশ্নে একে অন্যকে ছাড় দিতে নারাজ (আলজাজিরার প্রতিবেদন অনুসারে)।