‘মা-বাবাও খুব কাঁদছিলেন, কিন্তু কিছুই করার ছিল না’
‘তারা আমাকে জোর করে নৌকার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তাদের হাতে লাঠি ছিল, সেটি দিয়ে আমাকে পেটানোর হুমকি দিচ্ছিল। আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম, চিৎকার করে কাঁদছিলাম। আমার মা-বাবাও খুব কাঁদছিলেন। কিন্তু তাদের কিছুই করার ছিল না।’
এভাবেই থাইল্যান্ডের আশ্রয় শিবিরের এক ১৩ বছর বয়সী রোহিঙ্গা কিশোরী তাঁকে তার পরিবারের সামনে থেকে ধরে নিয়ে পাচারের কথা বর্ণনা করছিল মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কাছে।
১৬ বছরের আরেক রোহিঙ্গা কিশোরী বলল, ‘সেখানে ছয়জন লোকের একটা দল ছিল। তারা বাংলাদেশের রাখাইন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের কাছে ছোরা এবং অস্ত্র ছিল। তারা আমাকে জোর করে একটি নৌকায় তুলেছিল এবং বলেছিল যে আমি মিয়ানমার ছেড়ে যাচ্ছি। তারা আমাকে জোর করে ওই ছোট্ট নৌকাটায় উঠিয়ে দিচ্ছিল। ওই নৌকায় আরো ১৫ জন রোহিঙ্গা নাগরিক ছিল। তাদের প্রত্যেককেই জোর করে নৌকায় তোলা হয়েছিল।’
মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ থেকে বিপজ্জনক নৌযাত্রার মাধ্যমে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে পৌঁছানোর সময় বেঁচে যাওয়া মানুষদের সঙ্গে কথা বলে মিলছে ভয়াবহ সব তথ্য। কিভাবে আর কতটা দুঃসহভাবে একেকটা দিন কাটিয়েছেন, তা উঠে আসছে তাদের কথায়। আজ বুধবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের এক প্রতিবেদনে এসব কথাই তুলে এনেছে।
হিউম্যান রাইট ওয়াচের সঙ্গে কথা হয় আরো একজন রোহিঙ্গা নারীর। নিজের স্বামী ও সন্তানের সঙ্গে কীভাবে তাঁকেও পাচারকারীরা ধরে নিয়ে এসেছে সে সম্পর্কে বলছিলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি আমার স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা হয়েছিলাম তখন একজন দালাল এবং অনেক মানুষ আমাদের উঠিয়ে নিয়ে যায়। তারা আমাদের জোর করে একটি বড় নৌকায় উঠিয়ে দেয়। সেখানে আমি পাচারকারীদের ভাষাও বুঝতে পারছিলাম না। আমি বার্মিজ বা রাখাইন ভাষায় কথা বলতে পারি না। আমি জানি না যে তারা কারা।’
যে নৌকায় তাদের তুলে দেওয়া হলো সেসব নৌকার পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। এক রোহিঙ্গা কিশোরী জানাল নৌকার পরিস্থিতি সম্পর্কে। সে বলল, ‘আমরা ওই নৌকায় দুই মাস কাটিয়েছি। সব সময়ই ছোট ছোট নৌকায় করে ওই বড় নৌকাটিতে মানুষ আনা হতো। আমরা (নারীরা) নৌকার নিচে অবস্থান করতাম। জায়গাটা খুবই ছোট ছিল। আমি নৌকার বাইরে কিছু দেখতে পেতাম না। শুধু বুঝতাম নৌকাটা উপরে এবং নিচে উঠছে। এর ওপরে মানুষদের ছুড়ে ফেলা হতো। পুরো সময়টা হতবুদ্ধি হয়ে এবং অস্বস্তিকর অবস্থায় কাটিয়েছি আমি।’
আরেক রোহিঙ্গা কিশোরী বলে, ‘আমাকে যখন ওই বড় নৌকায় নিয়ে যাওয়া হলো সে সময়কার অনুভূতি আমি বর্ণনা করতে পারব না। আমি খুব ভীত ছিলাম। একটা ছোট্ট কক্ষে আমরা ১৬ জনের মতো মানুষ ছিলাম। দরজা সব সময় বন্ধ থাকত। পাচারকারীরা ছোট একটা ছিদ্র দিয়ে খাবার এবং পানি দিত। আমরা কখনোই তাদের চেহারা দেখিনি।’
মানবাধিকার সংস্থাটি বলছে, আগামী ২৯ মে ব্যাংককে হতে যাওয়া আঞ্চলিক সম্মেলনে সাগরে ভাসমান নৌকার মানুষদের ব্যাপারে আলোচনা করে একটি সমাধানে অবশ্যই পৌঁছাতে হবে।
সীমিত খাবার ও পানি দিয়ে কীভাবে দুই মাস তারা সাগরে ভেসে থেকেছে সেসব কথা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছে রোহিঙ্গারা। সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের প্রধান ব্রাড অ্যাডামস রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানিয়েছেন।
অ্যাডামস বলেন, ‘মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করা বন্ধ করতে হবে। সেইসঙ্গে থাইল্যান্ড ও মালেশিয়ার উচিত তাদের মাটিতে যেন আর গণকবর পাওয়া না যায় সে লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেওয়া।’
এর আগে এ মাসের শুরুতে মালয়েশিয়ার পেরলিস রাজ্যের পেদাং ও ওয়াং কেলিয়ান অঞ্চলের জঙ্গলে ৩০টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এ ছাড়া থাইল্যান্ডের শঙ্খলা প্রদেশের জঙ্গলে আরো কয়েকটি গণকবরের সন্ধান পায় দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব কবরে বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের নাগরিকদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এ ছাড়া ১১ মে থেকে ১৩ মে চালানো কয়েকটি অভিযানে থাইল্যান্ডের সীমান্তঘেঁষা এলাকায় ১৩৯টি কবর ও ২৮টি বন্দিশিবিরের সন্ধান পাওয়া যায়।