সূর্য না ডোবা শহরে রোজা
রাশিয়ার শহর সেন্ট পিটার্সবার্গে জুন মাসে কোনো রাত নেই বললেই চলে। সূর্য সত্যিকার অর্থে এখানে অস্ত যায় না। গত বৃহস্পতিবার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরসহ উত্তর রাশিয়ায় রোজা শুরু হয়েছে। শীর্ষ স্থানীয় একটি ইসলামিক সংগঠন জানিয়েছে, এই অঞ্চলে রোজা রাখতে হবে ২২ ঘণ্টা, যা এক অর্থে কঠিনই বলা চলে।
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, উত্তর রাশিয়ায় মে মাসের শেষের দিক থেকে জুলাইয়ের শুরু পর্যন্ত সময়টাকে ‘হোয়াইট নাইট’ হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। এই সময় প্রকৃত রাতের অন্ধকার কখনোই দেখা যায় না। সময় রাত হলেও সূর্যের আলো কিছুটা থেকেই যায়। হোয়াইট নাইট উদযাপনের সঙ্গে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহর ওতপ্রতভাবে জড়িত। কারণ রাশিয়ার সাংস্কৃতিক রাজধানী হলো ১০ লাখ অধিবাসীর শহর সেন্ট পিটার্সবার্গ।
পিটার্সবার্গ শহরের মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্য এটি অন্যরকম উত্তেজনাপূর্ণ সময়। অসুস্থ ব্যক্তি, ভ্রমণকারী, গর্ভবতী মায়েদের জন্য রমজান মাসে রোজা করা বা না করার বিষয়ে নির্দেশনা আছে কুরআনে। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে পূর্ব প্রান্তে রোজা রাখার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।
সেইন্ট পিটার্সবার্গের মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের অনেকে মনে করেন, বছরের এই সময়ে দীর্ঘ ২২ ঘণ্টা রোজা রাখা তাঁদের বিশ্বাসের পরীক্ষায় একটি বাড়তি চ্যালেঞ্জ।
সেন্ট পিটার্সবার্গ ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের মুসলিম আধ্যাত্মিক কেন্দ্রের এক কর্মচারী বলেন, সেন্ট পিটার্সবার্গের মুসলমানরা দীর্ঘ সময় রোজা রাখাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করে। রোজা পালনকারী মুসলমানরা ২১ থেকে ২২ ঘণ্টা রোজা রাখার পর মাত্র দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় পাবে। এই সময়েই ইফতার ও সেহরি করতে হবে।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, তাঁদের বিশ্বাসের দৃঢ়তার কারণে এই অঞ্চলে রোজা রাখা ও সব কিছু ঠিক সময়ে পালন করা তেমন কঠিন হয় না। তিনি বলেন, ‘ইসলাম হলো জীবনের বিধান। আমাদের জন্য রোজা রাখা হলো প্রাত্যহিক কাজের মতোই।’
স্থানীয় একটি স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইলিজাভেটা ইজমাইলোভা বলেন, স্থানীয় মুসলিম কর্তৃপক্ষের দেওয়া সময়সূচি অনুযায়ী তিনি ও তাঁর পরিবারের সবাই রোজা রাখেন। এই মাসে রোজা শেষ হতে দীর্ঘ সময় নেবে। ভোর ২টায় সকালের নামাজের পূর্ব থেকে তাঁরা আহার ও পান থেকে বিরত থাকেন। ইফতারের সময় হয় রাত ১০টার দিকে। তিনি আরো বলেন, অবশ্যই এই অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য রোজা আলাদা চ্যালেঞ্জ। প্রায় সব মুসলমানই এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে।
সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রকৃতপক্ষে কত মুসলমান আছে তার সঠিক হিসাব নেই। তবে একটি হিসাব থেকে জানা গেছে, গত বছর ঈদুল ফিতরে শহরের দুটি মসজিদে ৪২ হাজার মুসলমান অংশ নেন। অনেক বন্ধের দিনই মসজিদে জায়গা না হওয়ায় অনেকে বাইরে চলে আসেন।
তবে উত্তর রাশিয়ায় রোজা রাখার বিষয়ে মুসলমান আধ্যাত্মিক নেতাদের মধ্যে কয়েকটি বিভক্তি দেখা যায়।
উত্তর রাশিয়ার একদল মুসলিম নেতার মতে, মেরু অঞ্চলের রোজা রাখা থেকে কেউ চাইলে বিরত থাকতে পারেন।
রাশিয়ার তাতার জাতিগোষ্ঠীর আধ্যাত্মিক নেতা মুসা বিঘিয়েভ বলেন, কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী মেরুর কাছাকাছি অঞ্চলে রোজা রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়নি।
অপর একদল মুসলিম নেতার মতে, উত্তর মেরুতে অবস্থানরত মুসলমানরা মক্কা অথবা কোনো নিকটবর্তী মুসলমান অধ্যুষিত শহরের সময় অনুযায়ী রোজা রাখতে পারেন।
তবে অনেক ক্ষেত্রেই নিরাপত্তার কারণে কাঠোর শারীরিক পরিশ্রম করেন পিটার্সবার্গের এমন মুসলমানরা রোজা রাখা থেকে বিরত থাকেন। পিটার্সবার্গের মুসলমানদের অধিকংশই এসেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্য এশিয়া এবং ককেশাস অঞ্চল থেকে। তাঁরা অনেকেই ভবন নির্মাণ বা অন্য কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। সেন্ট পিটার্সবার্গের শ্রম মন্ত্রণালয়ের মতে, শহরটিতে কোটা অনুযায়ী এক লাখ ৬৪ হাজার প্রবাসী শ্রমিক আছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।
পিটার্সবার্গের ধাতব বস্তু তৈরির একটি কারখানায় কাজ করেন তাজিকিস্তান থেকে আসা শাকির। তিনি বলেন, প্রচণ্ড পরিশ্রমের কাজে যুক্ত থাকায় তিনি রোজা রাখতে পারেন না। তাঁর মতো এমন অনেকেই আছেন। তিনি দাবি করেন, হোয়াইট নাইট উদযাপিত হয় এমন সব অঞ্চলেই মুসলমান আছে।