ঋণদাতাদের প্রতি গ্রিসের ‘না’
গ্রিকদের সামনে উপায় ছিল দুটি—হয় দাতাদের কঠোর কৃচ্ছ্রের শর্ত মেনে আন্তর্জাতিক ঋণ নেওয়া, অথবা তা প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে ইউরোজোন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি। এ দুইয়ের মধ্যে দাতাদের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছে গ্রিসের জনগণ।
দেশটির চলমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দাতাদের কঠিন শর্তের ঋণ জনগণ গ্রহণ করবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গতকাল রোববার গ্রিসে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় শুরু হয়ে একটানা সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলে। ভোট দেন গ্রিসের প্রায় ৯৯ লাখ ভোটার। এর মধ্যে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অন্তত ৬১ শতাংশ ভোটারই দাতাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
‘এ আরেক গ্রিক রূপকথার গল্প। এ গল্প স্পর্ধার, দেশপ্রেমের গল্প এটি।’ এভাবেই বিজয়ী হওয়ার পর নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস।
আর্থিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য দাতাদের দেওয়া শর্তগুলো মর্যাদাহানিকর বলে বরাবরই সমালোচনা করেছে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে গ্রিসের ক্ষমতায় আসা বামপন্থী সিরিজা পার্টি।
গ্রিসের সমস্যাটির শুরু ২০১০ সালে। সে বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আইএমএফ থেকে দুটি কিস্তিতে প্রায় ২৪০ বিলিয়ন ইউরো ঋণ নেয় গ্রিস। এই ঋণের অর্থে চলতে থাকে দেশটি, যদিও তার জন্য নাগরিকদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। এ সময়ে গ্রিসে পেনশন, বেতন ও সরকারি সেবায় কাটছাঁট হয়।
এর পর নতুন করে ঋণ-সহায়তার জন্য গ্রিসকে কর বাড়ানোর পাশাপাশি জনকল্যাণমূলক ব্যয় কমানোসহ কঠিন আর্থিক পুনর্গঠনের শর্ত দেয় ইউরোজোন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোজোনের সঙ্গে টানাপড়েনের মধ্যে আর্থিক সংকট বাড়ে দেশটিতে। সপ্তাহজুড়ে ব্যাংকগুলো বন্ধ রাখে সরকার, পাশাপাশি এটিএম বুথ থেকে দিনে ৬০ ইউরোর বেশি না তোলার বিধান জারি করা হয়।
এ অবস্থায় আইএমএফের পাওনা টাকার কিস্তি পরিশোধের ও অন্যান্য বিষয়ে একটি বিকল্প উপায় নিয়ে ভাবছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা। বসেছিলেন আলোচনায়ও; কিন্তু কোনো প্রস্তাব পাস হওয়ার আগেই গ্রিক প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস এক গণভোটের ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘গ্রিস ইইউ ও দাতাদের প্রস্তাবের পক্ষ নেবে, নাকি বিপক্ষে যাবে—তা ঠিক করবে দেশটির জনগণ।’
তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা হুঁশিয়ারি দেন, গ্রিসের জনগণ যদি ‘না’ ভোট দিয়ে ঋণদাতাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তা হলে গ্রিসকে ইউরোজোন থেকে বের করে দেওয়া হবে। শুধু তা-ই নয়, ‘না’ ভোটের বিজয়ে গ্রিক ব্যাংকগুলোর তহবিল বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং তা গ্রিসকে একক মুদ্রা ইউরো থেকে বের হয়ে যাওয়ার পথে নিয়ে যাবে।
তখন গ্রিসের অর্থমন্ত্রী ঋণদাতাদের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘তাঁরা গ্রিসের সঙ্গে যে আচরণ করছেন, তা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ।’
আর প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস আশ্বাস দিয়েছিলেন, ‘সব দুর্দশা কাটিয়ে উঠবে গ্রিস। শুধু আস্থা রাখুন আমাতে।’ এ ছাড়া গ্রিসে গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হলে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন তিনি।
গত শুক্রবার ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ ভোটের প্রচারণাকারী উভয় পক্ষই বড় ধরনের সমাবেশের মধ্য দিয়ে প্রচার শেষ করে। বিরোধী দলগুলো দাতাদের চুক্তি মেনে নিতে ‘হ্যাঁ’ ভোটের পক্ষে প্রচার চালিয়েছিল। আর এই ভোট সামনে রেখে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে গ্রিসবাসী।
‘হ্যাঁ’ পক্ষের সমর্থকদের ধারণা, দাতাদের প্রস্তাব মেনে না নিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থার পতনের মধ্য দিয়ে ইউরো ছেড়ে পুরোনো মুদ্রা ড্রাকমায় ফিরে যাওয়া তাদের আরো বেশি বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে। অন্যদিকে ‘না’ সমর্থকরা মনে করেন, আরো ঋণের বিনিময়ে কর বাড়ানো ও পেনশন কাটছাঁটের মধ্য দিয়ে ব্যয়সংকোচন গ্রিসের প্রতি চারজনের একজনকে বেকার বানিয়ে দেবে। আর এ চাপ গ্রিস নিতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস জনগণের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনাদেরই ঠিক করতে হবে, মর্যাদা নিয়ে ইউরোপে থাকতে চান কি না।’ আর রোববার ভোটের প্রাক্কালে বলেছেন, ‘না’ ভোটের বিজয় ‘শুধু ইউরোপে থাকা নয়, ইউরোপে মর্যাদা নিয়ে থাকতে’ গ্রিসের সংকল্পের প্রতিফলন ঘটাবে।
গতকাল সন্ধ্যায় ভোট শেষ হওয়ার পর প্রাথমিক গণনাতেই ‘না’ ভোটের জয়ের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। জনমতের রায়ও গিয়েছিল ‘না’-এর পক্ষে। আর গ্রিসের জনগণ আস্থা রেখেছে দেশের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাসেই।