বন্দিশিবির থেকে মেয়ের আর্তনাদ, ‘মাগো বাঁচাও’
সিরিয়ার রাকা শহর। জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দখলে থাকা শহরটির বাসিন্দারা ধুঁকে ধুঁকে এগিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর দিকে। আইএস সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবের মুখে তাঁরা অসহায়। মৃত্যুভয় তাঁদের তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিটি মুহূর্ত। এমনই পরিস্থিতির মধ্যে শহরটি থেকে ভেসে আসে মাহা (ছদ্মনাম) নামের এক নারীর আর্তচিৎকার, ‘মাগো, আমাকে বাঁচাও।’
মাহার (২৩) মা ওয়াফা (ছদ্মনাম) থাকেন রাকা শহর থেকে দুই হাজার মাইল দূরে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম শহরে। নিজের বাসায় বসে কাঁপা হাতে মোবাইল ফোনটি হাতে নেন তিনি। ভয় ভয় চোখে তাকান হোয়াটসঅ্যাপের দিকে। চ্যাটিং অ্যাপটির স্ক্রিনে ভেসে ওঠে সাহায্য চেয়ে পাঠানো মেয়ের ওই বার্তা।
সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে এই গল্প শোনাতে শোনাতে চোখের কোনায় পানি চলে আসে ওয়াফার। তিনি জানান, মেয়ের কাছ থেকে বার্তা পাওয়ার পর, ফিরতি বার্তা দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ফোনের দিকে। কখন মেয়ে সেই পাঠানো বার্তা দেখবে।
ওয়াফার এই অপেক্ষা কখনো কখনো চলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ। কারণ, আইএস রাকা দখল করার পর শহরটিতে ইন্টারনেট সংযোগ নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, ‘যখন আমি কোনো খবর পাই না, কিছু শুনতে পাই না, মনে হয় ভেতরে ভেতরে আমি মারা যাচ্ছি।’
২০১৪ সালে রাকা থেকে পালিয়ে নেদারল্যান্ডসে চলে যান ওয়াফা। স্বামী ও ছেলে নিয়ে মাহা থেকে যান রাকায়। কথা ছিল তাঁরাও কিছুদিন পর পাড়ি দেবেন নেদারল্যান্ডস। কিন্তু পূরণ হয়নি তাঁদের সেই স্বপ্ন। আইএসের বন্দিদশা থেকে কোনোভাবেই মুক্ত করতে পারেননি নিজেদের।
এদিকে, দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে আসতে থাকে মাহার জীবনে। তাঁর স্বামীর মোবাইল ফোনে পাওয়া যায় সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর এক সৈন্যের খুদেবার্তা। এর ফলে তাঁকে শিরশ্ছেদ করে আইএস। স্বামীহারা মাহা ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে পড়েন ঘোর বিপাকে।
আইএসের হাত থেকে মুক্তির জন্য সন্তানকে নিয়ে এখনো ছুটে বেড়াচ্ছেন মাহা। সাহায্য চেয়ে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠাচ্ছেন মা ওয়াফার কাছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
মেয়ের পাঠানো বার্তাগুলো সিএনএনের কাছে প্রকাশ করেন ওয়াফা। মর্মস্পর্শী ওই বার্তাগুলোতে বারবার বেঁচে থাকার আকুতি জানিয়েছেন মাহা। বার্তাগুলোতে দেখা যায়, নেদারল্যান্ডস থেকে ওয়াফাও মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন পুরোটা দিয়ে। মাহাকে বারবার বলেছেন রাকা, শহর থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য।
কিন্তু রাকার পরিস্থিতি অনেক কঠিন। সেখানের বাসিন্দাদের বাইরের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা নিষেধ। এ কাজ করে কেউ ধরা পড়লে তাঁদের জন্য নিষ্ঠুর শাস্তির ব্যবস্থা করেছে আইএস নেতারা। এ ছাড়া শহরজুড়ে চলছে কড়া প্রহরা। সেখান থেকে পালানো এক প্রকার অসম্ভব।
মাহা গোপনে যোগাযোগ করেন মায়ের সঙ্গে, সপ্তাহে এক-দুবার। হয়তো বা আরো কম। শহরে নেই খাবার, পানি, বিদ্যুৎ। মাহা মাকে লেখেন, পানির অভাবে কষ্ট পাচ্ছে শিশুসন্তান ওদাই। ছেলের জন্য দুধ কেনার টাকাও নেই তাঁর কাছে। কারণ, আইএস নিয়ন্ত্রিত রাকায় দ্রব্যমূল্য অনেক চড়া।
আইএসের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার সংগ্রামের একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দিতে চান মাহা। হোয়াটসঅ্যাপে মাকে জানান, আত্মহত্যা করবেন তিনি। লেখেন, মা যদি তাঁকে সাহায্য করতে না পারেন, তাহলে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
মাহাকে উদ্ধারের সব রকমের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ওয়াফা। যোগাযোগ করেছেন সাংবাদিক-আইনজীবী-চিকিৎসক সবার সঙ্গে। কিন্তু কেউ কথা শুনছেন না। দুশ্চিন্তায় তিনি দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মাহার বেঁচে থাকার আকুতি। বাড়তে থাকে ছেলেকে বাঁচাতে মায়ের চেষ্টা। মাহা এখনো অসহায় জীবন কাটাচ্ছেন রাকা শহরে। ছেলেকে সুস্থ রাখতে চলছে তাঁর সংগ্রাম। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মৃত্যুর হাতছানি থেকে। শেষ পর্যন্ত কী হবে? মাহা কি মুক্তি পাবেন আইএসের বন্দিশিবির থেকে? ভালো কিছু ঘটবে, এ আশাতেই বসে আছেন মাহার মা ওয়াফা।