দেশে দেশে ঈদুল ফিতর উদযাপন
আরবি শাওয়াল মাসের এক তারিখ ঈদুল ফিতর। রমজানে দীর্ঘ এক মাস সিয়ামসাধনার পর আসে খুশির এই ঈদ। দেশে দেশে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয় ঈদুল ফিতর। ঈদের সকালে ঈদের নামাজ ও স্বজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ সব দেশের মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। তবে ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুর কারণে বিভিন্ন দেশে ঈদুল ফিতর পালনে কিছুটা পার্থক্য থাকে।
সৌদি আরব
ঈদ উপলক্ষে সৌদি আরবের মানুষ ঘর সাজায় এবং আত্মীয়স্বজনের জন্য বিশেষ খাবার তৈরি করে। সকালে ঈদের নামাজের পর সৌদিরা বাবার বাড়িতে একত্র হয়। বিশেষ খাবারের আগে শিশুরা পরিবারের বড়দের সামনে লাইন ধরে ঈদের সালামি নেয়। এ ছাড়া পরিবারের শিশুদের জন্য উপহারও দেওয়া হয়। সুন্দরভাবে সাজানো এসব উপহারের ব্যাগে সাধারণ চকলেট বা খেলনা থাকে। সৌদি আরবের বিপণিবিতানগুলোতে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ উপহারের ব্যবস্থা রাখা হয়। সৌদিরা একদম অপরিচিত মানুষের সঙ্গেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে এবং অপরিচিত ব্যক্তিটির শিশুদের উপহার দেয়। অনেক সময় সৌদিরা খাবার রান্না করে বাড়ির মূল ফটকের কাছে গবিব মানুষের জন্য রেখে দেয়।
মধ্য সৌদি আরবে কোনো এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের বাড়িতে তৈরি খাবার নিয়ে একটি নিদিষ্ট স্থানে রাখে। পরে সবাই একসঙ্গে খায়। ঈদ উপলক্ষে সৌদি আরবের বড় শহরগুলোতে আতশবাজির আয়োজন করা হয়।
তুরস্ক
ইউরোপের মুসলিম অধ্যুষিত দেশ তুরস্কে ঈদুল ফিতরকে বলা হয় ‘সেকার বাইরাম’ (বাইরাম অব সুইটস) ও ‘রামাদান বাইরাম’। ঐহিত্যগতভাবে বাইরাম উপলক্ষে ইস্তাম্বুল শহর কর্তৃপক্ষ বিখ্যাত ‘ব্লু মস্ক’ বা সুলতান আহমেদ মসজিদের মিনারে রঙিন আলো জ্বালানো হয়। ঈদুল ফিতরে তুরস্কে তিনদিন সরকারি ছুটি থাকে। ঈদের দিন তুর্কিরা নিজেদের সবচেয়ে ভালো পোশাকটি পরে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঈদ উপলক্ষে নতুন পোশাক কেনে তুর্কিরা। একে অপরকে ‘বাইরামিনিজ মুবারাক’ বা ‘মুতলু বাইরামলার’ বলে শুভেচ্ছা জানায়। ঈদে তুর্কিরা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যায়। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে অনেক তুর্কি একসঙ্গে কবর জিয়ারত করতে যায়। ঈদের দিন সকালে কাছাকাছি মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ে তুর্কিরা। তুর্কিরা বয়স্কদের হাতে ডান চুমো খায় ও হাত কপালে রেখে ঈদের শুভেচ্ছা জানায়। ঈদের দিনে তুরস্কের শিশুরা নিজেদের এলাকার বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায় ও ঈদের শুভেচ্ছা জানায়।
আর এসব শিশুকে উপহার দেওয়া হয় চকলেট বা ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি অথবা নগদ অর্থ। তুরস্ক শহর কর্তৃপক্ষ ঈদ উপলক্ষে গরিবদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে তুরস্কে আলো-ছায়ার খেলায় বিশেষ নাটক (অনেকটা পুতুল নাচের মতো) ও ব্যান্ডের বাজনার আয়োজন করা হয়।
মিসর
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে মিসরে তিনদিন সরকারি ছুটি থাকে। ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে মিসরীয়রা হালকা খাবার খায়। ঈদের নামাজে পুরুষের পাশাপাশি, নারী ও শিশুরা অংশ নেয়। পরে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ এলাকা বাসিন্দাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে মিসরীয়রা। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে মিসরীয়রা আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যায়। ঈদুল ফিতরের পরে দুদিন পরিবারের সঙ্গে পার্ক, সিনেমা, থিয়েটার বা সমুদ্রতটে ঘুরতে যায়। এ ছাড়া ঈদে অনেকে নীল নদে নৌবিহারেও বের অনেক অনেক মিসরীয়। ঈদের ছুটিতে মিসরীয়দের সবচেয়ে জনপ্রিয় অবকাশযাপনে সবচেয়ে অন্যতম জনপ্রিয় স্থান হলো শারম আল শেখ। ঈদ উপলক্ষে শিশুদের নতুন পোশাক দেওয়া হয়। এ ছাড়া পরিবারের নারী সদস্যরা বিশেষ উপহার। শিশুরা বড়দের কাছ থেকে ঈদি পায়। অনেক শিশুপার্কেও শিশুদের ভিড় দেখা যায়। মিসরের পরিবারগুলো ঈদ উপলক্ষে চিনি আর বাদাম দিয়ে বিশেষ খাবার বানায়। এই বিশেষ খাবার অনেক সময় বাসায় না বানিয়ে বেকারি থেকেও কিনে আনা হয়। ঈদ উপলক্ষে মিসরের টিভি চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় শিশুদের জন্য আয়োজন করা হয় গল্পের আসর, পাপেট শো।
দক্ষিণ আফ্রিকা
শাওয়ালের চাঁদ দেখতে রমজানের শেষ দিনে দক্ষিণ আফিকার কেপ টাউনের গ্রিন টাউনে হাজারো মুসলমান একত্রিত হন। ওই সময় প্রত্যেকেই কিছু খাবার নিয়ে আসেন এবং একসঙ্গে সবাই ইফতার করেন। সকালে ঈদুল ফিতরের নামাজ হয় মসজিদে। ঈদ উপলক্ষে পরিবারের সবাই একত্রিত হয়। শিশুরা বড়দের কাছ থেকে ঈদ উপলক্ষে কিছু অর্থ পায়। বেশির ভাগ মানুষ ঈদে নতুন জামা পড়ে। অতিথি আপ্যায়নে বিস্কুট, কেক, সমুচাসহ নানা খাবার আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে পরিবারের সবাই একসঙ্গে খাবার খায়। এ ছাড়া ঈদে উপহার আদান প্রদানের বিষয়টিও লক্ষণীয়।
সুদান
সুদানের ৯৭ ভাগ মানুষ মুসলমান। রমজানের শেষ কয়েকটি রোজার সময় থেকেই দেশটিতে ঈদের আয়োজন শুরু হয়। ঈদ উপলক্ষে দেশটিতে বিশেষ ধরনের বিস্কুট ও কেক তৈরি হয়। এ ছাড়া পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন পোশাক কেনা অথবা বানানো হয়। মেয়েরা মেহেদি দিয়ে হাত রাঙায়। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে বাড়ি সাজানো হয় ও নতুন করে রঙ করা হয়। ঈদের দিন বাড়ির পুরুষরা (অনেক সময় নারীরাও) ঈদের নামাজে অংশ নেয়। ঈদের ছুটিতে পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে আত্মীয় ও প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যায়। অল্প সময়ের জন্য বেড়াতে আসা অতিথিদের হালকা নাশতা করানো হয়। আর দীর্ঘ সময় বেড়াতে আসা অতিথিদের জন্য ভারী খাবারের আয়োজন করা হয়।
শিশুদের উপহার হিসেবে খেলনা ও অর্থ দেওয়া হয়।
নাইজেরিয়া
নাইজেরিয়া ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হলেও এখানে বড় একটি জনগোষ্ঠী মুসলমান। এখানে ঈদকে বলা হয় ‘স্মল সালাহ’। ঈদের সবাই শুভেচ্ছা বিনিময়ে বলে ‘বারকা দা সালাহ’। এখানে মাঠে ঈদের নামাজ পড়া হয়। ঈদ উপলক্ষে নাইজেরিয়ার পরিবারগুলো বিশেষ খাবার রান্না করে। ঈদ উলক্ষে নাইজেরিয়ায় ছুটি থাকে দুদিন।
আফগানিস্তান
আফগানিস্তানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তিনদিনব্যাপী ঈদুল ফিতর উদযাপন করা হয়। ঈদ উপলক্ষে আফগানরা তাদের বাড়িঘর পরিষ্কার করে। ঈদের নতুন পোশাক কেনা হয়। ঈদ উপলক্ষে তৈরি করা হয় বিশেষ সব খাবার। ঈদের দিন সকালে নামাজের পর আফগানরা পরিবার ও স্বজনদের নিয়ে একত্র হয়। ঈদ মুবারক বলে তারা একে অপরকে ঈদের শুভেচ্ছা জানায়। পরিবারের শিশুদের অর্থ ও উপহার দেওয়া হয়। শিশুরা এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে ঘুরে ঈদের শুভেচ্ছা জানায়। এ সময় তাদের বিভিন্ন খাবার দেওয়া হয়।
পাকিস্তান
পাকিস্তানে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে মানুষ নতুন পোশাক পড়ে। পাকিস্তানে ঈদের ছুটি হয় তিনদিন। সম্প্রতি ঈদ উপলক্ষে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের মধ্যে ঈদের কার্ড বিতরণের বিষয়টি দেখা যায়। ঈদের নামাজ পড়া হয় খোলা মাঠে। সকালে ঈদের নামাজের পর সবাই কোলাকুলি করে। ঈদের নামাজ থেকে ফেরার পথে গরিবদের দান করা হয়। এ ছাড়া পরিবারের জন্য মিষ্টি ও উপহার কেনে। ঈদের আনন্দ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শিশুদের মধ্যে। শিশুরা পরিবারের বড় ও আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে সেলামি পায়। ঈদ উপলক্ষে পাকিস্তানের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে পাকিস্তানের অনেক স্থানে মেলা ও বিশেষ খেলার আয়োজন করা হয়।
ভারত
ভারত ও উপমহাদেশের অনেক দেশের ঈদ আয়োজনে অনেকটাই মিল পাওয়া যায়। ঈদের আগের রাতকে বলা হয় ‘চাঁদরাত’। ওই সময় ভারতসহ উপমহাদেশের অনেক দেশেই বিপণিবিতানগুলোতে ভিড় দেখা যায়। মেয়েরা মেহেদিতে হাত ও পায়ে নকশা আঁকে। ঈদ উপলক্ষে থাকে নতুন পোশাক। ঈদের শিশুদের কিছু অর্থ ঈদি হিসেবে দেওয়া হয়। ঈদের নামাজের পর অনেকেই মৃত স্বজনদের কবর জিয়ারত করেন। ঈদ উপলক্ষে আয়োজন করা হয় সেমাই, পায়েসসহ বিভিন্ন খাবার। ভারতের দিল্লির জামে মসজিদ, হায়দ্রাবাদের মক্কা মসজিদ, কলকাতার লাল সড়কসহ ভারতজুড়ে বিভিন্ন মসজিদ ও খোলা স্থালে ঈদের নামাজ পড়া হয়। ঈদের অমুসলিম প্রতিবেশীরাও মুসলমানদের বাড়িতে বেড়াতে যান। হায়দ্রাবাদে ঈদের আয়োজন হয় সবচেয়ে ব্যাপক।
মালয়েশিয়া
ঈদে মালয়েশিয়ার মানুষ শহর ছেড়ে বাড়িতে আসে। বাড়িতে পরিবারের অপর সদস্যদের সঙ্গে ঈদ পালন করে মালয়রা। মালয়েশিয়ার প্রতন্ত্য অঞ্চলগুলোর মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনদের তকরিব দিতে শোনা যায়। ঈদ উপলক্ষে মালয়েশিয়ার পরিবারগুলো বিশেষ খাবার রান্না করে। ঈদুল ফিতরে মালয়েশিয়ার মুসলমানরা ঐহিত্যবাহী পোশাক পড়ে। মালয়েশিয়ার শহরাঞ্চলের মানুষ বাড়িতে প্রতিবেশী ও স্বজনদের আতিথেয়তা করে।
যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্যে ঈদুল ফিতরে মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে অনেক সময় ছুটি দেওয়া হয়। ঐহিত্যবাহী পোশাক পড়ে যুক্তরাজ্যের অনেক মুসলমান ঈদের নামাজে অংশ নেন। ঈদের নামাজ হয় অনেক পার্ক ও মসজিদে। ঈদের নামাজে মুসলমানরা একে অপরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। বাড়িতে ফিরে পরিবার পরিজনের সঙ্গে সবাই ঈদের খুশি ভাগাভাগি করে নেয়। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের জন্য বিশেষ খাবার তৈরি করে যুক্তরাজ্যের মুসলমানরা।
যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রে ঈদের নামাজ হয় বড় শহরের ইসলামিক সেন্টার, কনভেনশন হল অথবা খোলা পার্কে। যুক্তরাষ্ট্রে থাকে বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির মুসলমানরা। একই সঙ্গে তারা ঈদের নামাজ পড়ে ও ঈদ উদযাপন করে। ঈদের দিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানরা একে অপরের বাড়িতে যায়। অনেক সময় কমিউনিটি মসজিদ, ইসলামিক সেন্টার বা ধনী কোনো মুসলমান পরিবার বড় পার্টির আয়োজন করে। অনেক সময় মুসলমান কমিউনিটি পার্ক বা কোনো অ্যাকটিভিটি সেন্টার সারা দিনের জন্য ভাড়া করে।
অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়ায় বেশ স্বাধীনভাবেই ঈদ পালন করেন মুসলমানরা। অধিকাংশ বড় প্রতিষ্ঠানই ঈদ উপলক্ষে মুসলমান কর্মচারীদের ছুটি দেয়। ঈদে মসজিদে অধিক মানুষ হওয়ায় রাস্তায় মানুষ চলে আসে। এই পেক্ষিতে পুলিশ ভিন্ন রাস্তা ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। অনেক সময় শহরের কোনো স্কুলের খেলার মাঠ বা স্টেডিয়ামে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। ঈদ উপলক্ষে অস্ট্রেলিয়ার অনেক স্থানেই মেলা আয়োজন করা হয়। ঈদের ছুটিতে সবচেয়ে বড় মেলাটি অনুষ্ঠিত হয় মেলবোর্নে। আর রাজধানীর ক্যানবেরায় ঈদ উপলক্ষে মেলা আয়োজন করে দেশটির পুলিশ বাহিনী।