জার্মানিতে কট্টর ডানপন্থী এএফডির উত্থানের নেপথ্যে
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই মুহূর্তে কট্টর ডানপন্থী ও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের জয়জয়কার চলছে। সেটা প্রাচ্যের দেশ ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার থেকে শুরু করে প্রতীচ্যের যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতীচ্যের আরেক দেশ জার্মানিতেও দীর্ঘদিন পর পার্লামেন্টে জায়গা করে নিয়েছেন কট্টর ডানপন্থীরা। গতকাল রোববারের নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো অ্যাঙ্গেলা মেরকেল চ্যান্সেলর পদে জয়লাভ করলেও ১৩ দশমিক এক ভাগ ভোট পেয়েছে অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) নামের একটি সংগঠন। এটিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম কোনো কট্টরপন্থী জাতীয়তাবাদী দল, যারা জার্মানির পার্লামেন্টে যাচ্ছে। এএফডি জার্মানিতে এখন তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি।
জার্মানির রাজনীতিতে কীভাবে এত প্রভাবশালী হয়ে গেল সংগঠনটি, তার কারণ ও পেছনের বিষয়গুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। এতে এএফডির নেপথ্যের ক্রীড়নকদের বহু তথ্যও উঠে এসেছে।
এএফডির বিষয়ে জার্মানির শীর্ষস্থানীয় সাপ্তাহিক সংবাদমাধ্যম ডাই জাইটের রাজনৈতিকবিষয়ক সম্পাদক খু ফ্যাম আলজাজিরাকে বলেন, ‘এএফডি রোববারের নির্বাচনে নিঃসন্দেহে সফল। বিশেষ করে পূর্ব জার্মানিতে তারা বেশি সফল।’
এএফডির ইতিহাস খুব একটা পুরোনো নয়। ২০১৩ সালে এই রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে আঞ্চলিক নির্বাচনে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পায় দলটি। কিন্তু ৫ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় তারা জার্মানির সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো, কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই এর জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে। এরপর আঞ্চলিক অন্য কিছু নির্বাচনে ভালো করায় রোববার অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় দলটি। এতে তৃতীয় স্থানে যাওয়ায় দলটির জনপ্রিয়তার মূলে কী আছে, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে।
মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশেই যখন উদ্বাস্তুদের সারি দিন দিন লম্বা হচ্ছে, তখন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল শরণার্থী ও অভিবাসীদের জন্য দরজা খুলে দেন। মেরকেলের এই নীতির তীব্র সমালোচনা ও বিরোধিতা করে সামনে চলে আসে এএফডি। দলটি মুসলিম বিরোধিতা ও অভিবাসন প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়।
এ বিষয়ে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউটের গবেষক জুলিয়ান গপফার্থ আলজাজিরাকে বলেন, ২০০৫ সালের পর থেকে অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের নেতৃত্বাধীন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নে (সিডিইউ) পরিবর্তন আসতে থাকে। ফলে ২০০৫ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে দলের ভেতরেই নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
এ রকম পরিস্থিতিতে এএফডি মেরকেলের নীতির বিকল্প নিয়ে হাজির হয়। জুলিয়ান গপফার্থ বলেন, ‘২০১৩ সালে যখন এএফডি গঠিত হয় তখন তারা মেরকেলের নীতির বিকল্প তুলে ধরে। ফলে সিডিএফের অনেক নেতাকর্মীই এএফডিতে চলে আসে। যাদের নতুন নেতৃত্বে এগিয়ে চলে এএফডি।’
সিডিইউ থেকে বেরিয়ে আসা ৭৬ বছর বয়সী নেতা গল্যান্ড গত ২ সেপ্টেম্বর এক ভাষণে বলেন, ‘দুই বিশ্বযুদ্ধে আমাদের সেনাদের ভূমিকা আমাদের জন্য গর্বের।’
সাবেক সিডিইউর এই নেতার বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে গপফার্থ বলেন, এভাবে অতীতকে স্মরণ করে এএফডি জার্মানদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। জার্মানিতে এভাবে আর কোনো রাজনৈতিক দল কাজ করেনি, যা জাতীয়তাবাদী জার্মানদের আকর্ষণ করে।
আলজাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়, অভিবাসন, শরণার্থী, মুদ্রা জটিলতা ও ইউরো বিষয়ে মেরকেলের গৃহীত নীতি যে ঠিক নেই, সেটা প্রমাণে অনেকটাই সফল হয় এএফডি। জার্মানিতে অভিবাসন, শরণার্থী ঠেকিয়ে জার্মানকে শক্তিশালী করার যে নীতি এএফডির পক্ষ থেকে নেওয়া হয়, সেটাই যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হয় জার্মানির মানুষের কাছে, যাদের বড় অংশই কট্টর জাতীয়তাবাদী।
গপফার্থ বলেন, ইউরোপে শরণার্থী সংকট নিঃসন্দেহে এএফডির উত্থানে ভূমিকা রেখেছে।
যদিও শুরুতে দলটির মূল উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের ঠেকানো এবং জার্মানিকে আরো শক্তিশালী করা, কিন্তু দিন দিন এটি অভিবাসন ও ইসলাম বিরোধিতার দিকে চলে যায়। দলের নীতির এই পরিবর্তন দেখে প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা বার্ন্ড লাক ২০১৫ সালে পদত্যাগ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি ভুল করেছি এবং সেটা বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছি।’
এএফডির সাম্প্রতিক প্রবণতা তুলে ধরে গবেষক জুলিয়ান গপফার্থ বলেন, ইউরো সংকটে এএফডির বিস্তৃতি বেড়েছে। কিন্তু বিশ্ব গণমাধ্যম যখন বিষয়টিকে তুলে ধরেছে, তখন দলটি দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে এএফডি বর্তমানে আরো শক্তিশালী হয়েছে এই বলে যে, অভিবাসীরা যদি জার্মানিতে ঢোকে তাহলে বদলে যেতে পারে দেশটির সংস্কৃতি।