হংকংয়ে বাংলাদেশের শর্মীর বিজয়গাঁথা
এখন হংকংয়ের শিল্প ও খাদ্য অনুরাগী মানুষের কাছে জনপ্রিয় একটি নাম ডাডল’স। মধ্য হংকংয়ের ডাডল স্ট্রিটের সাংহাই তাং ম্যানসনের সর্বোচ্চ তলায় স্থাপিত এই স্থানটিতে একই ছাদের নিচে পাওয়া যায় দারুণ সব খাবার, দুর্লভ শিল্পকলা আর মনোমুগ্ধকর আবহাওয়া। জনপ্রিয় এই ডাডল’সের আর্ট প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন একজন বাংলাদেশি। মাত্র ২৮ বছর বয়সী ওই বাংলাদেশি তরুণীর নাম শর্মী আহমেদ। নিজের কাজের জায়গায় দারুণ প্রতিষ্ঠিতও তিনি।
হংকং ইকোনমিক জার্নালে শর্মী আহমেদকে নিয়ে ২৪ জুলাই প্রকাশিত হয়েছে একটি প্রতিবেদন। চীনা ভাষার প্রতিবেদনটির ইংরেজি অনুবাদ করে পরে পত্রিকাটির ইংরেজি ওয়েবসাইট ইজে ইনসাইটে তা প্রকাশ করা হয়। এতে শর্মী তাঁর বেড়ে ওঠা, হংকংয়ে অভিযোজন, লেখাপড়া, আগ্রহ, বাংলাদেশের স্মৃতি, ক্যারিয়ারসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলেছেন।
ইজে ইনসাইটের প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছে এভাবে- অনেকেই তাঁকে ফিলিপিনো, নেপালি অথবা ভারতীয় ভেবে ভুল করেন। তবে শর্মী আহমেদ জন্মসূত্রে বাংলাদেশি। ১৩ বছর বয়স থেকে হংকংয়ে বাস করছেন তিনি। এখন তাঁর বয়স ২৮ বছর। তিনি নিজেকে বাংলাদেশি হওয়ার পাশাপাশি হংকংয়ের নাগরিকও মনে করেন। যদিও তিনি ক্যানটোনিজ ভাষায় কথা বলতে পারেন না।
৯০-এর দশকে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার কাজে প্রথম হংকংয়ে আসেন শর্মীর বাবা। ১৯৯৯ সালে তিনি তাঁর পুরো পরিবারকে নিয়ে হংকংয়ে বসবাস করতে শুরু করেন।
হংকং শহর এবং এর মানুষকে ভালোবাসেন শর্মী। তিনি বলেন, ‘এখানে বাস করা ক্লান্তিকর হতে পারে। এখানকার ব্যস্ত আর ব্যয়বহুল জীবনের সাথে খাপ খাওয়াতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। কিন্তু হংকংয়ের নাগরিকরা এসব থেকে বের হয়ে আসতে পারে এবং ভীষণ জীবনীশক্তি নিয়ে বাঁচে।’
গত বছর হংকংয়ের আমব্রেলা মুভমেন্ট/ছাতা আন্দোলন থেকে দারুণ প্রভাবিত শর্মী। হংকংয়ে জীবন যাপনে অনেক সমস্যা থাকলেও শর্মী এই শহরটাকে ভালোবাসেন। তিনি বলেন, ‘হংকংয়ের একটা নিজস্ব চরিত্র আছে এবং এখানকার সবাই অনন্য। এখানকার স্থানীয়রা নিজেদের ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু যখন তারা সেটা করে খুব ভালোভাবে করে। ছাতা আন্দোলন ছিল এটার খুব ভালো একটা উদাহরণ। আমি হংকংয়ে অসংখ্য সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছি এবং প্রতিদিনই এখান থেকে আমি নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করি। উন্নতি করতে চাই।’
তবে এত কিছুর পরও নিজের দেশকে ভোলেননি শর্মী। বিয়ের প্রসঙ্গে জানতে চাইতেই তিনি বলেন, তাঁর মা-বাবা চান তিনি যেন বাংলাদেশি কাউকেই বিয়ে করেন।
শর্মী বলেন, ‘মানুষ ভালোবাসার কারণে একজন আরেকজনের সঙ্গে যুক্ত হয়। বিয়ের ক্ষেত্রে এটা পারস্পরিক বোঝাপড়া ও বিশ্বাসের বিষয়। এটা সত্যিকারের পারিবারিক বন্ধনের মতো ছিল।’
শর্মীর মা-বাবা ব্যবসার প্রয়োজনে একজন আরেকজনের কাছাকাছি এসেছিলেন। পরে তাঁদের পরিবার দুজনের বিয়ের ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশ বিশ্বায়নের দরজা খুলে নিয়ে পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোয় বেশ খুশি শর্মী। তিনি বললেন, ‘প্রেমের বিয়ে এখন সেখানে গ্রহণযোগ্য। সেখানে প্রেমের বিষয়টা হংকংয়ের মতো নয়। যদি আপনি কারো সঙ্গে প্রেম করেন, তবে তার সঙ্গেই বিয়ে হয়। বেশির ভাগ বাংলাদেশি এখনো কঠিনভাবে ইসলামি রীতিনীতি মেনে চলেন এবং নারীদের এক পুরুষের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে শেখানো হয়।’
শিল্প বিষয়ে উৎসাহী শর্মী আক্ষেপ করে বলেন, বাংলাদেশে শিল্পকলা বিষয়ে খুব কম শেখানো হয়। সেখানে চারুকলা ও সংগীত শিক্ষা পাঠ্যক্রমের অংশ হলেও আমাদের কখনো সেগুলো পড়তে হয়নি। ভালো ফলাফলের জন্য সংগীতকে কোনোভাবেই গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
হংকংয়ের স্থানীয় ভাষা শিখতে না পারার জন্যও আক্ষেপ রয়েছে শর্মীর। তিনি হংকংয়ে যে স্কুলে পড়তেন সেখানে সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা শ্রেণিতে ক্লাস করতে হতো তাঁকে। ফলে হংকংয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কখনোই একসাথে বসে ক্লাস করতে পারেননি তিনি।
হংকং শহরে ১৬ বছর কাটিয়ে দেওয়ার পর শর্মী এখন এখানকার স্থানীয় ভাষা বুঝতে পারেন। যদিও ট্যাক্সিচালককে গন্তব্য বুঝিয়ে দেওয়া ও বাস থেকে নামতে চাওয়া ছাড়া অন্য কোনো ক্যানটোনিজ ভাষা বলতে পারেন না তিনি।
হংকং সার্টিফিকেট অব এডুকেশন এক্সামিনেশন (এইচকেসিইই) পরীক্ষায় ১৬ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হলেও অঙ্কে শর্মী পেয়েছিলেন ‘এফ’ গ্রেড। যেখানেই সাক্ষাৎকার দিতে গেছেন সেখানেই তাকে শুনতে হয়েছে যে এত খারাপ গ্রেড নিয়ে তিনি স্থানীয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভতি হতে পারবেন না।
তবে নিজের যোগ্যতায় ইউনিভার্সিটি অব হংকং স্কুল অব প্রফেশনাল এবং হংকং কমিউনিটি কলেজে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যান শর্মী। শিল্পকলা ও তুলনামূলক সাহিত্য বিষয়ে হংকং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করেন তিনি।
শর্মীর কর্মজীবনের পথ পরিক্রমাকে অসমান বলা যেতে পারে। তিনি ইংরেজি, ফরাসি, বাংলা এবং উর্দূতে কথা বলতে দক্ষ। তবে ক্যানটোনিজ ভাষায় কথা বলতে না জানার কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছেন তিনি।
শর্মী বলেন, ‘ছাত্রাবস্থা থেকেই শিক্ষানবিস হিসেবে যেকোনো কাজ করতে বা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার সুযোগ খুঁজছিলাম আমি। আমি শিল্পকলা ও সাহিত্যে আগ্রহী। তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম যে শিল্পকলা সংক্রান্ত কর্মজীবনই আমি বেছে নেব। কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন। অনেকেই আমার আবেগ বা ইচ্ছাটাকে বুঝেছেন কিন্তু চীনা ভাষা না জানার কারণে আমাকে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে।’
একবার শর্মী একটি চিত্র প্রদর্শনী কেন্দ্রে চাকরির জন্য গেলেন। কিন্তু চাকরিটি তাঁর হয়নি। কারণ প্রদর্শনী কেন্দ্র এমন একজনকে খুঁজছিল যার ইংরেজি ও ক্যানটোনিজ দুই ভাষাতেই সমান দক্ষতা আছে। তিনি ভাবলেন, যেহেতু তিনি চীনা ক্যানটোনিজ ভাষা জানেন না সেহেতু চাকরি না হওয়াটা ঠিকই আছে। কিন্তু সেখানে সেই একই পদে কিছুদিন পর একজন ব্রিটিশ নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয় যিনি একবর্ণও ক্যানটোনিজ ভাষা জানেন না।
পছন্দের চাকরি না পেয়ে শর্মী আহমেদ জনসংযোগবিষয়ক কাজ শুরু করলেন। এর মধ্যে শিল্পকলা সম্পর্কিত একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজও করেন তিনি।
এক বছর পর শর্মীর অধ্যবসায় শেষ হলো। তিনি এখন আর্ট প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে ডাডল’সে কর্মরত আছেন। এমনকি একটি শিল্প উৎসবের ট্যুর গাইড হিসেবে কাজ করারও প্রস্তাব পেয়েছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে শর্মী বলেন, ‘সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ ছিল না। জনসংযোগ বিষয়ে আমার কর্মদক্ষতা ভালো ছিল। আমার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমার কাজ পছন্দ করতেন এবং আমি বেশ ভালো উপার্জন করছিলাম। তবে যাই হোক শিল্পকলা আমার ভালোবাসা এবং আমি এটা একবার করতে চাইছিলাম।’
শর্মী আহমেদ নিজেকে বাংলাদেশ ও হংকংয়ের নাগরিক ভাবতে ভালোবাসেন। হংকংয়ের ঐতিহ্যবাহী দাই পাই দং-এ খাওয়া-দাওয়া করতে ভালোবাসেন। শহরের এই ধরনের রাস্তার পাশের খাবার দোকানে খাবার খাওয়ার সময় নিজের দেশের কথা মনে পড়ে যায় তাঁর।
মাঝেমধ্যে স্থানীয়রা তাঁকে ভিনদেশি তরুণী বলে ডাকে। তবে নিজেকে ভিনদেশি বলে মনে করেন না শর্মী। তিনি বলেন, ‘আমি ১৬ বছর ধরে হংকংয়ে বাস করছি। হ্যাঁ এটা ঠিক যে আমি বাংলাদেশে জন্মেছি কিন্তু হংকংয়ের নির্যাস আমাকে পরিপূর্ণ করেছে।’