‘আমি যদি আমার ছেলেটার নাম রাখতে পারতাম!’
প্রতিটি যুদ্ধ বা গণহত্যাকে শুধু যুদ্ধ বা গণহত্যা বললেই শেষ হয়ে যায় না। ঘটনার শিকার প্রতিটি পরিবারেরই থাকে আলাদা আলাদা গল্প। তেমনই এক গল্প হলো রানজুমার পরিবারের গল্প। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার ৯৬ ঘণ্টার এক দীর্ঘ গল্প। এই গল্পে নৌকা থেকে রিকশা। রিকশা থেকে গোরস্থান কত কীই না দেখল এই পরিবার।
রানজুমা (২৫) নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামী নূর হোসেন (৪০)। তাঁদের ছোট ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে তাঁরা পাড়ি জমিয়েছিলেন বাংলাদেশের পথে। সঙ্গে ছয়জনের জন্য ছিল মাত্র দুই লিটার পানি। সঙ্গে ছিল রানজুমার ভাই ও নূর হোসেনের মা। হাঁটতে হাঁটতে রানজুমার পা ফুলে গিয়েছিল।
গল্পের দ্বিতীয় দিন। বাংলাদেশে পৌঁছেছেন রানজুমার পরিবার। তবে ভাগ্য সহায় হয় না তাঁদের। ঘটে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা। সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে শুধুমাত্র প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু রানজুমার ২২ বছর বয়সী ভাই ইয়াকুব আলীর আঘাত ছিল মারাত্মক। ডাক্তার বলে, তাঁর আঘাত ভেতরে, যার চিকিৎসা এই হাসপাতালে সম্ভব নয়। তাঁকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তবে পথেই মারা যান ইয়াকুব আলী।
চতুর্থ দিনে ভাগ্য আরো কিছু নিয়ে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছিল। এদিন রানজুমার প্রসব ব্যথা শুরু হয়। তিনি যমজ বাচ্চা আশা করছিলেন, কেননা তাঁর পেট অস্বাভাবিক বড় হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিকটবর্তী অন্য একটি ক্লিনিকে যান।
কিন্তু পথেই শিশুটির জন্ম হয়। ডাক্তার বলেন, তাঁর পেটে ফোঁড়া হওয়ার কারণে পেট অস্বাভাবিক বড় হয়েছিল। আর এই ফোঁড়ার কারণেই শিশুটির ওজন প্রয়োজনের চাইতে কম ছিল। জন্মের পর নিশ্বাস নিতে পারছিল না সে। অন্য একটি হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছিল তাঁকে।
সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, জন্মের মাত্র ২০ মিনিটের মাথায় সে মারা যায়! শিশুটির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যেন ব্যর্থ হয়ে যায় রানজুমার নয় মাসের কষ্ট। কিংবা ব্যর্থ হয়, মিয়ানমার সরকার, বাংলাদেশ সরকার। কিংবা ব্যর্থ হয় বিশ্বমানবতা।
দুঃসহ এই চারদিনের পর গিয়েছিলাম কক্সবাজার শরণার্থী ক্যাম্পে। ফের কথা হয়েছিল রানজুমা আর নূর হোসাইনের সঙ্গে। সেদিন কিছুই বলেননি নূর হোসাইন। শুধু বলেছিল, আমি যদি আমার ছেলেটার নাম রাখতে পারতাম! তাহলে অন্ততপক্ষে তাঁর কথাও বলা হতো।’