বিপ্লব-পরবর্তী প্রজন্মের হাতে কিউবার নেতৃত্ব
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালে প্রবল প্রতাপশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠনের পর ছয় দশক বিপ্লবী ফিদেল কস্ত্রোর পরিবারের হাতে ক্ষমতা থাকা দ্বীপরাষ্ট্র কিউবার নেতৃত্ব এই প্রথমবারের মতো বিপ্লব-পরবর্তী প্রজন্মের হাতে অর্পিত হচ্ছে।
২০০৮ সালে ফিদেল কস্ত্রো প্রায় পাঁচ দশক ক্ষমতায় থাকার পর ভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে দেশটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব তুলে দিলেও মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশ পরিচালনায় তাঁর প্রভাব ছিল একজন ‘কমানদেতা’ বা ‘কমান্ডারের’ মতোই।
বিপ্লবী রাউল কাস্ত্রো দশ বছর রাষ্ট্র ও কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষপদে থাকার পর ৫৮ বছর বয়সী মিগুয়েল ডিয়াজ-কানেলের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করতে যাচ্ছেন। মিগুয়েলের জন্ম বিপ্লবের পরবর্তী বছর, যে বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিদেল রাষ্ট্রীয় কাজ শুরু করেন। পাঁচ বছর আগেই মিগুয়েল ৮৬ বছর বয়সী রাউলের ‘রানিং মেট’ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন।
কমিউনিস্ট শাসিত কিউবার সংসদের ৬০৫ জন সংসদ সদস্য রাউলের ‘ডান হাত’ মিগুয়েলকে সর্বসম্মতভাবে দেশটির শীর্ষপদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করেছে। আজ বৃহস্পতিবার সেটি প্রকাশ করা হবে। এবং হতে পারে এদিনই নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মিগুয়েল শপথ নেবেন।
আগের দিন বুধবার কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুধু মিগুয়েলের নামই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সংসদের প্রস্তাব করা হয়। তারপর রুদ্ধদ্বার গোপন ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে মিগুয়েল প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে রাউল ২০২১ সাল পর্যন্ত কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পদে থাকবেন।
রাউল কাস্ত্রো ক্ষমতায় এসে আদর্শিকভাবে চিরবৈরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে বারাক ওবামা সরকারের সময় দুই দেশেই নতুন করে দূতাবাস খোলা হয়। দেশের ভিতরেও কিছু অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ শুরু হয়।
তবে রাউলের ক্ষমতার সময়ে একদলীয় শাসন থেকে ক্যারাবীয় দ্বীপ দেশটি বেরিয়ে আসবে এমন আশা করেননি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দুই দশক আগে যুব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে আসা প্রকৌশলবিদ্যার ছাত্র মিগুয়েলও সেই একই অর্থনৈতিক মডেল অনুসরণ করবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
তবে উদারবাদী নেতা হিসেবে পরিচিত মিগুয়েল দেশের ভিতর কর্মসংস্থানের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে এগিয়ে নেবেন। তবে নতুন প্রেসিডেন্ট দেশে গণতান্ত্রিক উদার পরিবেশের প্রতি নজর দেবেন এমন প্রত্যাশা আছে তরুণদের। যদিও ‘খোলাবাজার’ নীতির মধ্য দিয়ে কিউবা পশ্চিমা-নীতি অনুসরণ করবে এমনটা মনে করেন না বৃদ্ধরা।
১৯৫২ সালে দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সামরিক অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন ফুলগেন্সিও বাতিস্তা সরকার। তিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুবই প্রিয় রাষ্ট্রপ্রধান। এ সময় কিউবা দ্বীপটি কার্যত মার্কিন উচ্ছৃঙ্খল ধনীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। জুয়া, যৌন ব্যবসা আর মাদক চোরাচালানের জন্য কিউবা তখন গোটা ল্যাতিন আমেরিকায় কুখ্যাতি পায়।
বাতিস্তা সরকারকে উচ্ছেদের জন্য ‘দ্যা মুভমেন্ট’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেন কিউবার তরুণ বিপ্লবীরা। এর নেতৃত্বে ছিলেন তরুণ ফিদেল কাস্ত্রো, রাউল কাস্ত্রোসহ অল্প সংখ্যক বিপ্লবী। সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে সান্টিয়াগোর কাছে মনকাডা সেনা ছাউনিতে আক্রমণের করেন কাস্ত্রো। কিন্তু সেটি ব্যর্থ হলে বহু বিপ্লবী হয় নিহত হযন। অনেকে ধরা পড়েন। এর মধ্যে ফিদেল কাস্ত্রোও ছিলেন। পরে বিচারে কাস্ত্রোর ১৫ বছরের সাজা হয়।
১৯৫৫ সালে সাধারণ ক্ষমায় জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মেক্সিকো পালিয়ে যান ফিদেল কাস্ত্রো। সেখানেই পরিচত হয় ল্যাতিন আমেরিকার আরেক বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারার সঙ্গে। দুই বছর পরে তাঁরা ফিরে আসেন কিউবায় আর ১৯৫৯ সালে বিপ্লব করেন।
তার পর থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকে সমাজতান্ত্রিক মডেলে রাষ্ট্র গঠনের মনযোগ দেন ফিদেল। আশির দশকের বেশ ভালো অর্থনৈতিক অগ্রগতিও হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবার অর্থনীতিতে ধস নামে। যা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি কিউবা।
যদিও এই কঠিন ও দুঃসময়েও কিউবার স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নতি ছিল চোখ ধাঁধানোর মতো। দেশটি এখন ল্যাতিন আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়ার মতো কিছু বামপন্থী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।